সমাজতন্ত্র
‘আফগানিস্তান’ কোনো একক রাষ্ট্র নয়
আফগনিস্তান, ইরাক, ইরান, সিরিয়া অঞ্চলের অস্থিরতা কমবে না যতক্ষণ না পশ্চিমাদের সাথে চীনের দ্বন্দ্বের শেষ না হয়। এই অঞ্চলের প্রতিটি দেশেই মার্কিনিরা আগ্রাসন চালায় এবং তারা বিপদে আছে। আর আফগানিস্তানে রাশিয়া আগ্রাসন চালিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হারায়। প্রতিটি দেশে এর প্রক্রিয়ায় উগ্রবাদ জন্মায়।
অর্থনৈতিকভাবে মার্কিনিরা আগের মতো সবল নেই। কিন্তু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। তবে তারা তা করতে চায় না। যে খরচ তা আজকের দুনিয়ায় সামলানো কঠিন। ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ কালে অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন / রাশিয়ার সাথে এই যুদ্ধ ছিল আদর্শের বা ইডিওলজিক্যাল। সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদ। বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছে। কিন্তু তার মধ্য থেকে রাশিয়া উঠে এসেছে এবং আজকের বিশ্ব দ্বন্দ্বের নায়ক হয়ে উঠেছে। ধারাবাহিকতায় মার্কিন বিরোধী। এটাই উগ্রবাদের উত্থানের পটভূমি। এই দুই শক্তির দ্বন্দ্ব।
চীন ?
২০ বছর আগের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দলিল দেখলে পরাশক্তি হিসেবে চীনের কোনো রেফারেন্স পাওয়া যাবে না। কিন্তু গত ২০ বছরে বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। দুনিয়ায় যার ভিত্তি চীনের মৌলিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। যার নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে। যদিও চীন সেই অর্থে ‘সমাজতন্ত্রিক’, প্রশাসনিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টির অধীনে। কিন্তু তার অর্থনীতি বাজার ভিত্তিক পুঁজিবাদী। এটি সনাতনী মার্ক্সবাদী ধারণাকে এতটাই বিরোধিতা করে যে এটিকে একটি নব্য ব্যবস্থা বলাই ভালো। তারা উঠে এসেছে প্রবলভাবে। তাই মার্কিনিদের প্রধান লড়াই তাদের সাথেই এবং সেটি বিশ্ব বাজার দখলের। আমেরিকা সেটা আগে অস্ত্র দিয়ে করতো। কিন্তু এখন দেখছে সেটা পারে না বা হয় না। তাই তারা বিশ্বের যত ঝামেলা তৈরি করেছিল বিশেষ করে ‘ইসলামী উগ্রবাদ’ ঠেকাতে সেটা থেকে সরে আসতে চাইছে। তারা চায় নিজেদের বাজার সামলাতে। অতএব এই উগ্রবাদ কালকেই চলে যাবে না।
উগ্রবাদ
এই উগ্রবাদী শক্তি তৈরি হয়েছে ক্রিয়া নয় প্রতিক্রিয়া হিসেবে। যেখানেই মার্কিনিরা অথবা রাশিয়া দখল করেছে সেখানেই এদের উত্থান। তারা ইসলামী জঙ্গিবাদ বলে ব্র্যান্ডিং করে -মার্কিনিরা ও তাদের মতপন্থীরাই এটা বেশি বলে - কিন্তু এর শুরু আত্নরক্ষায়। মানুষের মনের ভাবনায় যেটা ‘দেশ’। তার ওপর আঘাত হানলে মানুষের তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। মাটি থেকে শত্রু উচ্ছেদের মূল উদ্দেশ্য, কোনো বিশেষ কায়দায় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা নয়। ওই অঞ্চলের মানুষের ‘ইসলামী’ সংস্কৃতিও রাজনীতির অংশ। আফগানিস্তানে যেমন তালেবানদের মূল চর্চা পুশতুনবাদ বা গোত্রবাদ। এটির চর্চা চলে ইসলামের নামে। কাবুল বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বোমা হামলা অনেককে হতবাক করেছে। কারণ সবার ধারণা ছিল সব ‘উগ্রবাদী ভাই ভাই’। কিন্তু সেটা যে নয় তার প্রমাণ আগেও ছিল। মার্কিনিরা কখনো বলেনি, আর সুশীল -লিবারেলরাও চায় এই ধারণা চলুক। কিন্তু এই আক্রমণ প্রমাণ করে প্রতি রাষ্ট্রের ভেতরে দ্বন্দ্ব আছে এবং এর শক্তির প্রকাশ ঘটে সহিংসতায়। আফগানিস্তান বা ইরাকের যে রাজনীতি তা অনেকটাই এরকম। অর্থাৎ আফগানিস্তানে তালেবান নিজ শক্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে বলে মনে হয় না। একদিকে মার্কিনিদের পলায়ন, অন্য দিকে রাশিয়া -চীনের প্রবেশ এই পরিসরে।
আফগানিস্তানসহ গোটা অঞ্চলে রক্তপাত বন্ধ হওয়ার সহসা সম্ভাবনা কম। মার্কিনিরা চাইবে আফগনিস্তানে ঝামেলা হোক যাতে তালেবান/রাশিয়া -চীন বিপদে থাকে। ঠিক একই কারণে তারা ক্রমেই সরব হবে অস্ত্রের ভাষায় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে উগ্রবাদীরা জিতবে না হারবে সেটা কথা নয়, আফগনিস্তানে শান্তির সম্ভাবনা কম। পুরাতন রাষ্ট্র গঠন ভাবনা বাদ দেয়া দরকার। এইসব রাষ্ট্রগুলো একক নয়, এতগুলো বিবাদমান গোষ্ঠীর একসাথে থাকা মানে ঝামেলা বাড়ানো। হয়তো আফগান বলে কেউ নেই, পুশতুন, খোরাসানি, ইত্যাদি আছে। তাই এক রাষ্ট্র বানাতে গেলে বিপদ হবেই। তারা প্রথমে গোষ্ঠী, শেষেও তাই। এটি কোনো একক জনগোষ্ঠী নয়, অনেকগুলো জনগোষ্ঠীর একসাথে বসবাস মাত্র। তবে সেই নয়া রাষ্ট্র অবধারিত হলেও কবে হবে এখনো বলা যাচ্ছে না। যুদ্ধ চলবেই, উগ্রবাদ চলবেই, যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল হবেই, চীন ও তার মিত্ররা সবল হবেই। পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে অর্থনীতি সরে আসছে। ওটাই মূল কথা, বাকি সব এই মহা পরিবর্তনের সূচক বলা যায়। কি হবে এখনো পরিষ্কার নয়।
লেখক: এডিটর এট লার্জ, ইউএনবি
আরও পড়ুন: তালেবান মাস্ক না পরলে কি কিছু এসে যায়
আমার আফগান স্টুডেন্টরা ও ১৯৭১ : ব্যক্তিগত অনুভূতি
৩ বছর আগে