সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পঞ্চগড় ভ্রমণের উপায়
বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন আকাশের বুকে ধূসর প্রকাণ্ড পাহাড়ের ওপর একগুচ্ছ রঙিন আঁচড়। কখনো তা শ্বেত-শুভ্র, কখনো সূর্য-কমলা। ২৮,১৬৯ ফুট উচু এই চূড়া মাথায় নিয়ে মহান হিমালয়ের অবস্থান নেপাল ও ভারতের সিকিম রাজ্যের মাঝামাঝি সীমান্তরেখায়। আর বাংলাদেশ থেকে এই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পঞ্চগড় ভ্রমণে যেতে হবে। দেশের সর্ব উত্তরের এ উপজেলাতেই রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম স্থলবন্দর। চলুন, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পঞ্চগড় ভ্রমণের উপায় ও আনুষঙ্গিক খরচ সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
পাঁচ গড়ের পঞ্চগড়
দেশের উত্তরাঞ্চলের শেষ বিভাগ রংপুরের জেলা পঞ্চগড়। ১৯৮৪ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি এটি বাংলাদেশের একটি জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এর পূর্বে ফাঁমাগড় প্রশাসন, পশ্চিমে ও উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণে ঠাকুরগাও ও দিনাজপুর জেলা।
জেলাটির নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুটি প্রধান কিংবদন্তি। প্রথম কিংবদন্তি বলে যে, পঞ্চগড়ের নামকরণ হয়েছে পুণ্ডু নগর রাজ্যের পঞ্চনগরী নামক একটি অঞ্চলের নামানুসারে।
আরও পড়ুন: শীতকালে বাংলাদেশে ভ্রমণের জনপ্রিয় ১০ স্থান
আর দ্বিতীয় মতানুসারে, এই তল্লাটে ছিলো ৫টি দুর্গ বা গড়। যেগুলোর নাম- ভিতরগড়, হোসাইনগড়, মীরগড়, দেবেনগড় ও রাজনগড়। এই ৫ গড় থেকেই পরবর্তীতে জায়গাটি পঞ্চগড় নামে পরিচিতি পায়; যার অর্থ ৫ দুর্গ।
পঞ্চগড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার উপায়
পঞ্চগড়ের কোন জায়গা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়
পঞ্চগড়ের অন্তর্গত তেঁতুলিয়া দেশের সর্ব উত্তরের উপজেলা। এই সদরের প্রাণকেন্দ্রে আছে একটি ঐতিহাসিক ডাকবাংলো। অনেক আগের এই স্থাপনাটির নির্মাণ কৌশল অনেকটা বিলেতি ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের। কথিত আছে- এটি নির্মাণ করেছিলেন কুচবিহারের রাজা।
জেলা পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত ডাকবাংলোটির পাশে তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছে সুন্দর একটি পিকনিক স্পট। দুটি স্থাপনা একসাথে দারুণ এক দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। সৌন্দর্যমণ্ডিত এ জায়গাটি দেখার জন্য ভূমি থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিটার উচুতে উঠতে হবে। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে স্রোতস্বিনী মহানন্দা। নদীর ওপারে ভারত আর এপারে সুউচ্চ গড়ের ওপর এই ডাকবাংলো ও পিকনিক স্পটটি। এই ডাকবাংলোর বারান্দা থেকেই দেখা যায় দূরের দিগন্তরেখায় ভেসে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
আরও পড়ুন: নারীর একাকী ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ১০ শহর
এছাড়া তেঁতুলিয়ার অন্যান্য জায়গার মধ্যে বাংলাবান্ধা, বাইপাস, ভজনপুর করতোয়া সেতু, ভিতরগড় থেকেও দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে।
পঞ্চগড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সেরা সময়
সাধারণত শীতকালে দূরের মেঘমুক্ত আকাশে যেন ভেসে থাকতে দেখা যায় তুষারশুভ্র পাহাড়ের চূড়া। রোদের আলোয় চিকচিক করতে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই মোহনীয় শোভা উপভোগ করার জন্য শীতই সবচেয়ে সেরা সময়। পাহাড় চূড়ার প্রাকৃতিক দৃশ্যটি সারা দিনের ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রুপ ধারণ করে। তাই বছরের যে কোন সময় না গিয়ে অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়টাতে যাওয়া উত্তম। এই সময়টাতে আকাশ একদম পরিষ্কার থাকে। মেঘের সঙ্গে বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার লুকোচুরি খেলার কোন উপায় থাকে না।
এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানের ফাঁকা জায়গায় দাড়ালে খুব ভোরে মেঘ ও কুয়াশামুক্ত নীল আকাশ জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোরম দৃশ্য পর্যটকদের খালি চোখেই এঁকে দেয় বিস্ময়ের চিহ্ন।
আরও পড়ুন: ইউএস-বাংলার বিমানে ভ্রমণ করলে হোটেল ফ্রি
ঢাকা থেকে পঞ্চগড় যাওয়ার উপায়
বাস ও ট্রেন; ঢাকা থেকে কেবল এই দুই মাধ্যমে পৌছানো যায় পঞ্চগড় জেলায়। ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনাল, শ্যামলী ও মিরপুর থেকে পঞ্চগড়ের বাস পাওয়া যায়। নন-এসি বাসে খরচ নিতে পারে মাথাপিছু ৯০০ থেকে ১১০০ টাকা, আর এসি বাস ভাড়া পড়তে পারে ১৩০০ থেকে ১৯০০ টাকা।
পঞ্চগড় নেমে লোকাল বাসে করে যেতে হবে তেঁতুলিয়ায়। এ পথে সারাদিনি চলাচল করে এই বাসগুলো। বাসের ভাড়া পড়তে পারে জনপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা। পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়া যাওয়ার পথে এশিয়ান হাইওয়ে পড়ে। ভাগ্য ভালো হলে এ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় দূরের আকাশে চোখে পড়তে পারে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য।
ঢাকা থেকে সরাসরি তেঁতুলিয়ারও বাস আছে। এগুলোর ভাড়া জনপ্রতি ১১৫০ টাকা পড়তে পারে।
আরও পড়ুন: সমুদ্রে স্নানের সময় সতর্ক থাকতে করণীয়
ট্রেনে যেতে হলে ঢাকার কমলাপুর থেকে সরাসরি পঞ্চগড় ট্রেন আছে। শ্রেণীভেদে ট্রেন ভাড়া জনপ্রতি সর্বনিম্ন ৫৫০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৯৪২ টাকা হতে পারে।
পঞ্চগড় নেমে এখানকার কেন্দ্রীয় বাসস্টেশন ও চৌরঙ্গী মোড়ে পাওয়া যাবে প্রাইভেট কার ও মাইক্রো। এগুলোতে করে পঞ্চগড়ের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যাবে। মাইক্রো ও প্রাইভেট কার রিজার্ভ করতে আনুমানিক কমপক্ষে ২,০০০ থেকে শুরু করে ৩,০০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া লাগতে পারে।
পঞ্চগড় ভ্রমণে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
তেতুলিয়া উপজেলায় আবাসিক হোটেলের নন-এসি রুম ভাড়া ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। এসি ডাবল বেডের ভাড়া পড়তে পারে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। মহানন্দা নদীর তীরের ডাকবাংলোতে থাকা যেতে পারে। তবে তার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে নিতে হবে। এই ডাকবাংলোতে কক্ষ প্রতি ভাড়া ৪০০ টাকা। এছাড়া আছে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের জেলা পরিষদের ডাকবাংলো এবং বন বিভাগের রেস্টহাউস। এগুলোতেও থাকার জন্য অনুমতির প্রয়োজন হবে।
আরও পড়ুন: পাহাড় ভ্রমণে দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় সতর্কতা
আর পঞ্চগড়ে এসে থাকতে চাইলে এখানে আছে সাধারণ মানের আবাসিক হোটেল। এখানে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় আছে নন-এসি কক্ষ এবং ১,০০০ থেকে ১,৫০০ টাকায় পাওয়া যাবে এসি কক্ষ।
পঞ্চগড়ের বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার রয়েছে, যেগুলো এখনো গ্রামগুলোতে রান্না হয়ে থাকে। অবশ্য এগুলোর অধিকাংশই এখন বিলুপ্তির পথে। খাবারগুলোর মধ্যে ডিম ভূনা, তেঁতুলিয়া উপজেলায় হালকা, শীদলের ভর্তা, পাটা শাকের খাটা, কাউনের ভাত, সজির মুড়ার ছ্যাকা ও মোড়ত লাভা শাকের পেলকা অন্যতম।
পঞ্চগড়ের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানসমূহ
কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় দৃশ্য ছাড়াও পঞ্চগড় ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক নিদর্শনের অপূর্ব উপচার সাজিয়ে রেখেছে। এগুলোর মধ্যে মহারাজার দিঘী, চা বাগান, ভিতরগড়, শাহী মসজিদ, মিরগড়, জিরো পয়েন্ট, রক্স মিউজিয়াম, এবং বারো আউলিয়া মাজার অন্যতম।
আরও পড়ুন: সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদী ভ্রমণ গাইড: যাওয়ার উপায় ও আনুষঙ্গিক খরচ
পরিশিষ্ট
বাংলাদেশ থেকে সুদূর কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য দর্শনে পঞ্চগড় ভ্রমণে পাওয়া যাবে এক অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের অভিজ্ঞতা। ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর নানা শ্রেণীর পর্যটকদের আসা-যাওয়ার ফলে এ অঞ্চলটিতে তৈরি হয়েছে পর্যটন শিল্পের সমৃদ্ধির সুযোগ। হাজার বছরের চমকপ্রদ ইতিহাস-ঐতিহ্য, পাথর ও চা শিল্প; সব মিলিয়ে ভ্রমণের জন্য এক পরিপূর্ণ এলাকা। শুধু প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়নের। বিশেষ করে সরকারি উদ্যোগে এখানে পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলে, এই ছোট্ট উপজেলাই পরিণত হতে পারে রাজস্ব আয়ের একটি কার্যকর উৎসে।
২ বছর আগে