ঢাকা-প্যারিস
প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে সম্পর্ককে 'কৌশলগত' পর্যায়ে নিতে চায় ঢাকা-প্যারিস
শান্তি, সমৃদ্ধি ও জনগণের জন্য অংশীদারিত্বকে ‘কৌশলগত’ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।
সরকারের অসাংবিধানিক পরিবর্তন এবং যেকোনো দেশে বেআইনি সামরিক দখলের নিন্দা জানায় উভয় দেশ। একই সঙ্গে সংঘাত, সহিংসতা ও নৃশংস অপরাধের কারণে বাস্তুচ্যুতদের জন্য জরুরি এবং নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তার আহ্বান জানান দুই দেশের নেতা।
কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য অংশীদারিত্বের কথা তুলে ধরে, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের প্রতি তাদের অটল প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স। বিশেষ করে সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের নীতি ও বহুপাক্ষিকতাবাদে অবিচল বিশ্বাসের উপর তারা জোর দিয়েছেন।
সেক্ষেত্রে ফ্রান্স ও বাংলাদেশ সব জাতির আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে।
২০২১ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরের সময় দুই দেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও সহযোগিতার বিষয়ে স্বাক্ষরিত লেটার অব ইনটেন্টের কথা স্মরণ করে দুই দেশ।
আরও পড়ুন: ঢাকা-প্যারিস দুটি সমঝোতা স্মারক সই
জলবায়ু জরুরি অবস্থা
বাংলাদেশ ও ফ্রান্স জলবায়ু জরুরি পরিস্থিতিতে দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার শক্তিতে বিশ্বাসী।
উভয় দেশই চারটি মূল নীতি অনুসরণ করে বৈশ্বিক অর্থায়ন কাঠামোর আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনপদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে: কোনো দেশকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই এবং গ্রহ রক্ষণবেক্ষণের মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে না- তা নিশ্চিত করা; স্থানান্তর কৌশলগুলোর দেশের মালিকানা নিশ্চিত করা; দুর্বল অর্থনীতিগুলোকে সমর্থন করার জন্য বর্ধিত এবং অনুমানযোগ্য সংস্থানগুলোর সঙ্গে একটি আর্থিক উদ্দীপনা সরবরাহ করা এবং গ্রিনহাউজ গ্যাস শূন্যের কাছে নামিয়ে আনার পাশাপাশি প্রকৃতিবান্ধব বিশ্ব অর্জনের জন্য অতিরিক্ত বেসরকারি মূলধন সংগ্রহ করা।
বাংলাদেশ ও ফ্রান্স মনে করে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়নে প্রবেশাধিকার সহজতর করতে বৈশ্বিক প্রচেষ্টা আরও ত্বরান্বিত করা উচিত।
যেসব দেশ চরম বিপর্যয় মোকাবিলা করে এবং ক্ষয়ক্ষতি তহবিলে সাড়া দেয় সেসব দেশকে জলবায়ু-সহনশীল ঋণ ধারাগুলোর আরও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সহায়তা অব্যাহত রাখবে ফ্রান্স। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু ঝুঁকির বিরুদ্ধে ভি২০-জি-৭ গ্লোবাল শিল্ড, যার মধ্যে বাংলাদেশ একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশ।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ঝুঁকিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সহায়তা করতে একটি তহবিলসহ নতুন অর্থায়ন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সহায়তা করে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স।
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করতে তাদের ইচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করেছে ফ্রান্স।
এ বছর দুবাইয়ে একটি ফলাফলভিত্তিক কপ-২৮ আয়োজনে যোগ দিতেও সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স।
নবায়নযোগ্য ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানি খাতে বিনিয়োগসহ জলবায়ু সহনশীল বিশ্বে জরুরি রূপান্তরের লক্ষ্যে কপ-২৮-এ একটি পথ প্রণয়নের প্রত্যাশা করে দুই দেশ।
তারা জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়াই বৈশ্বিক শক্তি রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনীয়তা পুনর্ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে নাবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন এবং জ্বালানি দক্ষতার জন্য উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ ও পূরণের প্রয়োজনীয়তার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন এবং জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা থেকে সরে আসার লক্ষ্য পুনর্ব্যক্ত করেছে ফ্রান্স। অন্যদিকে বাংলাদেশ সাশ্রয়ী মূল্যের অর্থ ও প্রযুক্তির মাধ্যমে তার জ্বালানি রূপান্তর প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য একটি টেকসই সহযোগিতামূলক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্ন বিশ্বব্যাপী খাদ্য সার্বভৌমত্ব, খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির উপর বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলছে বলে একমত প্রকাশ করেছে দুই দেশ।
এ ছাড়া নিয়মিত সংলাপের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার সমর্থনে টেকসই ও স্থিতিশীল খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থায় সহযোগিতা জোরদারে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স।
এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সের নেতৃত্বে ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার রেজিলিয়েন্স মিশনে (ফার্ম) বাংলাদেশের যোগদানের প্রশংসা করেছে ফ্রান্স।
পানি শোধন থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, নগর উন্নয়ন থেকে শুরু করে অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্যসেবাসহ জলবায়ুভিত্তিক প্রকল্প এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফ্রান্সের উন্নয়ন সহযোগিতা সহায়তার ভূয়সী প্রশংসা করেছে বাংলাদেশ।
এ ছাড়া বন ও জলাভূমি দ্বারা প্রদত্ত গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুসংস্থান সেবার গুরুত্বের উপর জোর দেয় দুই দেশ। সেই সঙ্গে জীববৈচিত্র্য ও কার্বন উভয়ের গুরুত্বপূর্ণ মজুদ বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে তাদের সহযোগিতা গভীর করার অঙ্গীকার করে দুই দেশের সরকার। এ ছাড়া ফ্রান্স দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বন ও এর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বাংলাদেশের অব্যাহত প্রচেষ্টার প্রশংসা করে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ আইসিটি ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে ফ্রান্স। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক গ্লোবাল পার্টনারশিপের মতো উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার আমন্ত্রণও জানায় ফ্রান্স।
তারা আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা পরিচালিত একটি বৈশ্বিক, উন্মুক্ত ও সুরক্ষিত সাইবার স্পেসের জন্য সাইবার নিরাপত্তা ইস্যুগুলোর বর্ধিত পরিচালনার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
সাইবার নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে কারিগরি সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে ফ্রান্স। একইসঙ্গে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গ্লোবাল ডিজিটাল কম্প্যাক্টেও একসঙ্গে কাজ করবে দুই দেশ।
সুশীল সমাজসহ জনকেন্দ্রিক যোগাযোগের জন্য অংশীদারিত্বের কথা তুলে ধরে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স সংস্কৃতিকে একটি শক্তিশালী, জনকেন্দ্রিক সংযোগের জন্য একটি প্রধান সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে।
এ ছাড়া প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে, বিশেষত অনন্য মহাস্থানগড় প্রত্নতাত্ত্বিক মিশনের মাধ্যমে তাদের দীর্ঘদিনের সহযোগিতার প্রশংসা করেন এবং অন্যান্য সম্ভাব্য খনন ও পুনরুদ্ধার মিশন নিয়ে আলোচনা করতে সম্মত হন তারা।
উভয় দেশ তাদের সাংস্কৃতিক সহযোগিতা আরও উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং এ ক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের প্রধান ভূমিকার কথা উল্লেখ করে।
উভয় দেশ বহুভাষিকতার গুরুত্ব স্বীকার করে বাংলাদেশে ফরাসি ভাষা এবং ফ্রান্সে বাংলা ভাষা শেখার প্রসারে প্রতিশ্রুতি দেয়।
পাশাপাশি বাংলাদেশের তরুণ কূটনীতিকদের জন্য ফ্রান্সে কূটনৈতিক ও ফরাসি ভাষার প্রশিক্ষণ দিতে সম্মত হয়েছে ফ্রান্স।
শান্তির সংস্কৃতির উন্নয়নসহ ইউনেস্কোর মধ্যে তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স।
পারস্পরিক বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও গবেষণা সহযোগিতা জোরদার করতে চায় দুই দেশ। এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে গবেষণা সহযোগিতা জোরদার করার উপায় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ওশান গভর্নেন্সে একজন ফরাসি সমুদ্রবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ নিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছে দেশটি।
স্থাপত্য, প্রকৌশল, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সমুদ্রবিজ্ঞান, সিসমোলজি, ক্লাইমেট অ্যাকশন, টেকসই পর্যটন ও উন্নয়ন অধ্যয়নের মতো অগ্রাধিকারমূলক বিষয়গুলোতে মনোনিবেশ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে মানবসম্পদ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উভয় দেশ আরও বেশি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ নিয়োগদানকে উৎসাহিত করার ইচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
বাংলাদেশ ও ফ্রান্স তাদের অংশীদারিত্বের কৌশলগত মাত্রাকে আরও গভীর করতে নিয়মিত উচ্চ পর্যায়ের সংলাপ শুরু করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ১০-১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে দ্বিপাক্ষিক সফর করেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সোমবার ঢাকায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করার জন্য সাক্ষাৎ করেছেন। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা, স্থিতিস্থাপকতার সমর্থনে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের জন্য একটি বিশ্বস্ত এবং অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার জন্য তাদের অভিন্ন প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
আরও পড়ুন: প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে ঢাকা-প্যারিস সম্মতিপত্র স্বাক্ষর
১ বছর আগে