‘সুন্দরবন দিবস’ পালনের আয়োজকরা প্রথম থেকেই সরকারের কাছে জাতীয়ভাবে ‘সুন্দরবন দিবস’ পালনের দাবি জানিয়ে আসছেন।
তবে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালনের উদ্যোগ না থাকলেও এবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরাসহ সুন্দরবন সংলগ্ন জেলাগুলোয় নানা আয়োজনে ‘সুন্দরবন দিবস’ পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সুত্র জানায়, ২০০১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি খুলনায় প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন ‘সুন্দরবন ঘোষণার’ মধ্য দিয়ে শেষ হয়। রূপান্তর, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাপা যৌথ ভাবে ওই সম্মেলনের আয়োজন করে। ওই সম্মেলনে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালবাসা দিবসে ‘সুন্দরবন দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। একইভাবে জাতীয়ভাবে ‘সুন্দরবন দিবস’ পালনের দাবি জানানো হয় সম্মেলন থেকে। এরপর ২০০২ সাল থেকে সুন্দরবনসংলগ্ন জেলাগুলোতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘সুন্দরবন দিবস’ পালন করা হচ্ছে।
খুলনার বেসরকারি সংস্থা রূপান্তরের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম খোকন জানান, ২০০১ সালে সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে আমরা জাতীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস পালনের দাবি জানিয়ে আসছি। জাতীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস পালন এখন সময়ের দাবি। কোনো কিছু সংরক্ষণ করতে হলে গৌরবের অংশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য সুন্দরবন সুরক্ষায় জাতীয়ভাবে ‘সুন্দরবন দিবস ’ পালনের কোনো বিকল্প নেই।
পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম খোকন আরও জানান, সুন্দরবন দিবস পালনে স্থানীয়ভাবে বন বিভাগ অংশগ্রহণ করলেও সরকারি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোনো সাড়া মেলেনি। সুন্দরবন রক্ষার জন্য সরকার যদি জাতীয়ভাবে ‘সুন্দরবন দিবস’ পালন করে তাহলে সুন্দরবন রক্ষার কাজটি সহজ হবে বলে তিনি মনে করেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন বলেন, সরকার সুন্দরবন রক্ষা করার জন্য আন্তরিক। সুন্দরবন সুরক্ষা করতে সরকার নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। জাতীয়ভাবে সুন্দরবন দিসব পালন করা হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুন্দরবনের গুরুত্ব তুলে ধরা সহজ হবে। একই সাথে সুন্দরবন রক্ষার কাজ আরো বেশি গুরুত্ব পাবে। তিনিও জাতীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস পালনের দাবি জানান।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, জাতীয় বা সরকারিভাবে সুন্দরবন দিবস পালনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সুন্দরবন বিভাগ কয়েক বছর ধরে বনসংলগ্ন জেলাগুলোতে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে যৌথ ভাবে সুন্দরবন দিবস পালন করছে। জাতীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস পালনের জন্য সরকারের কাছে লিখিতভাবে কোনো দাবি করা হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই।
মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী আরও জানান, ২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বন দিবস পালন করা হয়। দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সুন্দরবন অনেক গুরুত্ব বহন করে চলেছে। সুন্দরবনের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে জাতীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস পালন করা যেতে পারে। এতে করে মানুষের মধ্যে সুন্দরবন নিয়ে সচেতনতা বাড়বে। আর সুরক্ষা পাবে সুন্দরবন।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. মাহমুদুল হাসান জানান, অবশ্যই জাতীয় ভাবে ‘সুন্দরবন দিবস’ পালন করা উচিত। সুন্দরবন সুরক্ষায় ‘সুন্দরবন দিবস’ পালনের কোনো বিকল্প নেই। যত বেশি মানুষকে যুক্ত করা যাবে সুন্দরবনের সম্পদ রক্ষায় তত বেশি সহয়াক হবে। সুন্দরবনের সম্পদ আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি ওই বন কর্মকর্তার।
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় গড়ে উঠেছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি সুন্দরবন নিজেই নিজের সৌন্দর্য দিয়ে গড়া। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে চলেছে সুন্দরবনের নয়নাভিরাম দৃশ্য। সুন্দরবন জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বিশ্বের মধ্যে সমৃদ্ধশালী একটি ইকোসিস্টোম। অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল বনটিতে। সুন্দরবন বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনও। ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগারের’ আবাসস্থল এখানে। সুন্দরবন প্রাকৃতিক দূর্যোগের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক দেয়াল হিসাবেও দাঁড়িয়ে আছে।
১৮৭৮ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবনের মোট আয়াতন ছয় হাজার ১৭ বর্গ কিলেমিটার। এর মধ্যে স্থল ভাগের পরিমাণ চার হাজার ১৪৩ বর্গ কিলোমিটার এবং জলভাগের পরিমাণ এক হাজার ৮৭৩ বর্গ কিলোমিটার।
কয়েক লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা সুন্দরবনের ওপর নির্ভর করে। এক সময়ে সুন্দরবন জলদস্যু-বনদস্যুদের অভয়ারণ্য থাকলেও এখন দস্যুমুক্ত। তবে বন্যপ্রাণী শিকারীদের তৎপরতা থেমে নেই।
সুত্র মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের একক বৃত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন দারুন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে চলতে গিয়ে ফার্নেস তেলবোঝাই ট্যাকংকার, কয়লাবোঝাই কার্গো এবং পাটাশিয়াম সারবোঝাই কার্গো জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের কাছে বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ভাবে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রথম থেকেই পরিবেশবাদীরা সুন্দরবন বাঁচাতে কয়লাভিত্তিক ওই বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধের দাবিতে আনন্দোলন চালিয়ে আসছেন।
সুন্দরবনের ইতিহাস ও নামকরণ: জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিশন ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেন। সুন্দরবনের প্রধান উদ্ভিদ প্রজাতি ‘সুন্দরী গাছ’। কারো কারো মতে সুন্দরী গাছের নাম অনুসারে প্রাকৃতি ভাবে গড়ে ওঠা বনের নাম হয়েছে সুন্দরবন। আবার সমুদ্রের কাছে অবস্থান হওয়ায় ‘সমুন্দর’ শব্দ হয়ে প্রথমে ‘সমুন্দবন’ ও পরে ‘সুন্দরবন’ নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
বন বিভাগের তথ্য মতে, দেশের মধ্যে বণ্যপ্রাণীর বৃহত্তম আবাসস্থল সুন্দরবন। সুন্দরবনে ৩৭৫ প্রজাতির অধিক বণ্যপ্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ প্রজাতির সরিসৃপ, ৩১৫ প্রজাতির পাখি ও ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ীপ্রাণী অন্তর্ভুক্ত। সুন্দরবনের প্রধান প্রধান বণ্যপ্রাণী হচ্ছে, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, বন্যশকুর, বানর, কুমির, ডলফিন, কচ্ছপ, উদবিড়াল, মেছোবিড়াল ও বন বিড়াল ইত্যাদি।
ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে সর্বশেষ গণনায় সুন্দরবনে ১০৬টি বাঘ রয়েছে। এছাড়া এক থেকে দেড় লাখ হরিণ, ৪০ থেকে ৫০ হাজার বানর, ২০ থেকে ২৫ হাজার বন্যশকুর, ২০০ শতাধিক কুমির ও ২০ থেকে ২৫ হাজার উদবিড়াল রয়েছে। সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। সুন্দরবনের প্রধান বনজদ্রব্য হচ্ছে সুন্দরী, পশুর, গেওয়া, ধুন্দুল ও কাকড়া গাছ। এছাড়া গোলপাতা, হেতাল, ছন, মাছ, মধু ইত্যাদি।