তাই এসব মামলার আইনি কার্যক্রম নিয়ে সংশয় কাটছেনা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তবে বিচারকার্য নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল তা অনেকটা কাটিয়ে ওঠছে।
উল্লেখ্য, উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ২৬টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় আরো ছয়টি বৌদ্ধ বিহার এবং শতাধিক বসতঘরে হামলা,লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। পরদিন (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে উখিয়া ও টেকনাফে আরও চারটি বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালানো হয়। এতে পুড়ে যায় এসব বিহারে থাকা হাজার বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক সব নিদর্শন।
এ ঘটনায় রামু,উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রামু থানায় ৮টি, উখিয়ায় ৭টি, টেকনাফে দুইটি ও কক্সবাজার সদর থানায় দুইটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে।
এর মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি ছিল ৩৭৫ জন। পরবর্তীতে এসব মামলায় ৯৯৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এর মধ্যে রামুর ৮টি মামলায় ৪৫৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের কোর্ট পরিদর্শক কাজী দিদারুল ইসলাম জানান, ১৯টি মামলার মধ্যে রামু থানায় জনৈক সুধাংশু বড়ূয়ার করা মামলাটি দু'পক্ষের আপোস মীমাংসার ভিত্তিতে খারিজ করে দেন আদালত।
বাকি ১৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন। এর মধ্যে ৫টি মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে দেয়া হয়। অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের শেষের দিকে তিনটি মামলার অভিযোগ পত্রও আদালতে দাখিল করে পিবিআই। তিনি বলেন, ১৮টির মধ্যে বর্তমানে ১৪টি সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে আছে। চারটি ট্রায়েলের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। তিনি বলেন,এসব মামলায় এ পর্যন্ত ৪২৬ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। পলাতক আছে ১০৬ জন।
কক্সবাজার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কক্সবাজার এর পরিদর্শক কৈশানু মার্মা জানান, রামুর উখিয়ারঘোনা জেতবন বৌদ্ধ বিহার,লট উখিয়ারঘোনা জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহার ও ফতেখাঁরকুলের লালচিং,সাদাচিং ও মৈত্রী বিহার এবং চাকমারকুল ইউনিয়নের অজান্তা বৌদ্ধ বিহার এবং উখিয়ার ১টি মামলা আদালত থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই-এর কাছে পাঠানো হয়।
তিনি বলেন, মোট ৫টি মামলা তাদের কাছে পাঠানো হলেও এর মধ্যে চারটি মামলা অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের শেষের দিকে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। বাকি একটি মামলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত করানোর নির্দেশনা ছিল আদালতের। কিন্তু ওই সময় এ পদ মর্যাদার কোনো কর্মকর্তা কক্সবাজার পিবিআই-এ না থাকায় তদন্ত কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। তাই পরবর্তীতে জবাব লিখে মামলাটি আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
সাক্ষ্য না দেয়া প্রসঙ্গে এ কর্মকর্তা বলেন, সাক্ষী পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে অনেককে সনাক্ত করে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আদালত চাইলে এদের শাস্তি দিতে পারে।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন বলেন,মূলত সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এসব মামলায় সাক্ষী বেশিরভাগই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তারা ভয়ে সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। তিনি বলেন, বেশিরভাগ সাক্ষী অনুপস্থিত থাকায় এসব মামলার বিচার বিলম্বিত হচ্ছে।
রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের আহবায়ক রজত বড়ুয়া রিকু বলেন, ১৮টি মামলার বাদীই পুলিশ। পুলিশ কাকে আসামি করেছে, কাকে বাদ দিয়েছে কিছুই বৌদ্ধ সম্প্রদায় জানে না। এমনকি যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিল, যারা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছে এরা কেউই পুলিশের অভিযোগপত্রে নেই। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে পুলিশকে বার বার তাগিদ দেয়া স্বত্ত্বেও প্রকৃত অপরাধীদের অনেকের অভিযোগপত্রে নাম আনা হয়নি। এ অবস্থায় বর্তমানে ভয়ে সাক্ষীরাও সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না।
তিনি বলেন,ঘটনার পর থেকে সরকার এবং সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। নতুন নতুন বৌদ্ধ বিহার ও বাড়ি ঘর নির্মাণসহ পুনর্বাসনের বিষয় নিয়ে সরকারের প্রতি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
বর্তমানেও সরকারের পক্ষ থেকে নানা সহযোগিতা অব্যাহত আছে। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের অনেকেই আইনের আওতায় না আসায় ঘটনায় দায়ীদের বিচার আদৌ হবে কি-না তা নিয়ে সংশয়ে আছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়।
কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, এই ছয় বছরে আমরা ভাঙা-গড়া,উত্থান পতন অনেক কিছুর মুখোমুখি হয়েছি। এ ঘটনায় রামুর হাজার বছরের গর্বের ধন ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে’ যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল তা আস্তে আস্তে কেটে ওঠছে। তবে পুরোটা ফিরে আসতে সময় লাগবে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ অবস্থায় সুষ্ঠু বিচারের পাশাপাশি সম্প্রীতির জায়গাটাকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করতে। সেটি হতে পারে সামাজিক ভাবে, রাষ্ট্রিয় ভাবে বা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বলেন, বর্তমানে মামলাগুলোর মূল সমস্যা হচ্ছে সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো নিরাপত্তা বিষয়টি ভেবে অনেকে সাক্ষী দিতে রাজি হচ্ছেন না। সাক্ষীদের সকল প্রকার নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পুলিশের। যদি কোনো অভিযোগ আসে সাক্ষীদের হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে,এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’।
রামু সহিংসতা স্মরণে সংঘদান ও ধর্মসভা-
এদিকে বিভীষিকাময় রামু সহিংসতার ছয় বছর অতিক্রান্তে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ শ্রীকুল লাল চিং-মৈত্রী কমপ্লেক্সে চত্বরে দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ৮টায় জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১০টায় সংঘদান ও অষ্ট উপকরণ দান,ধর্মসভা, বেলা বারটায় অতিথি ভোজন, দুপুর ২টায় মৈত্রীর্যালী, ৩টায় ধর্মসভা এবং বিকাল ৫টায় দেশ ও বিশ্বশান্তি কামনায় হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও সমবেত প্রার্থনা।
স্মরণ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন একুশে পদক প্রাপ্ত রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ, উপসংঘরাজ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের।