ট্রলারে হামলা চালিয়ে জাল ও মাছ লুট এবং অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা দস্যুদের কাছে ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। মুক্তিপণ না দিলে দস্যুদের আস্তানা থেকে জেলেদের মুক্তি মেলেনি। দস্যুদের অত্যচারে জেলে-বাওয়ালীরা অতিষ্ট হয়ে উঠে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, অবশেষে সুন্দরবন ‘দস্যুমুক্ত’ হয়েছে। এতে বনসংশ্লিষ্টরা আতঙ্কমুক্ত হয়েছে। আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে স্বস্তিবোধ করছে দস্যু ও তাদের স্বজনরাও।
‘সুন্দরবনের কুখ্যাত ৩২টি দস্যু বাহিনী প্রধানসহ ৩২৮ জন জলদস্যু দফায় দফায় আত্মসমর্পণ করে স্বভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। ওইসব দস্যুদের আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে সুন্দরবনে জলদস্যু অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছে, জানায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব।’
স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরে দস্যু এবং তাদের পরিবারের সদস্যরাও খুঁশি। সুন্দরবনে নতুন করে আর যেন দস্যু বাহিনী তৈরি হতে না পারে এমন দাবি সব মহলের মানুষের।
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় অবস্থান বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবন। সুন্দরবনের মোট আয়াতন ছয় হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থলভাগের পরিমাণ চার হাজার ১৪৩ বর্গ কিলোমিটার এবং জলভাগের পরিমাণ এক হাজার ৮৭৩ বর্গ কিলোমিটার।
র্যাব সুত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৩১ মে সুন্দরবনের কুখ্যাত জলদস্যু মাস্টার বাহিনীর প্রধানসহ ১০ দস্যুর আত্মমর্পণের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় দস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রক্রিয়া। এর পর দফায় দফায় দস্যুরা আত্মসমর্পণ করে স্বভাবিক জীবনে ফিরে আসে। সর্বশেষ গত ৩০ অক্টোবর ছয়টি বাহিনী প্রধানসহ ৫৪ জন জলদস্যু বাগেরহাট শেখ হেলাল উদ্দীন স্টেডিয়ামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের হাতে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দস্যুদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেন।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, সুন্দরবনে আর কোনো জলদস্যু-বনদস্যু বাহিনী সৃষ্টি হতে দেয়া হবে না। নতুন করে দস্যু বাহিনী সৃষ্টি হলে কঠোর ভাবে দমন করা হবে। আর দস্যুদের যারা অস্ত্র সরবারহ করেছে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ জানালেন, সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে। এখন দস্যুমুক্ত পরিবেশ ধরে রাখা চ্যালেঞ্জ। আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সাবেক দস্যুদের বিভিন্ন পুনর্বাসন প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার কথা জানালেন তিনি।
আত্মসমর্পণ করতে আসা দস্যু এবং পূর্বে আত্মসমর্পণ করা সাবেক দস্যু ও তাদের পরবিারের সদস্যরাও নানা ভাবে তাদের অভিব্যাক্তি জানিয়েছেন।
আত্মসমর্পণ করা সাত্তার বাহিনীর প্রধান মো. আব্দুল সাত্তার মল্লিক (৪০) জানান, সাত বছর আগে সে সুন্দরবনে দস্যুতার খাতায় নাম লিখিয়েছিল। সুন্দরবনের হারবারিয়া, ভদ্রা এবং বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন উপকূলবর্তী এলাকায় তার বাহিনী সক্রিয় ছিল। দস্যুতার সাথে জড়িয়ে জীবনে যে ভূল করেছে দেরিতে হলেও সে বুঝতে পেরেছে। স্বভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য দলের ১১জন সদস্যকে নিয়ে সে আত্মসমর্পণ করেছে। দস্যুতার খাতায় যেন কেউ নাম না লেখায় এমন কথাই জানালে সাত্তার।
আনোয়ারুল বাহিনীর প্রধান আনোয়ারুল ইসলাম গাজী (৪০) জানান, জীবনে অনেক ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমি দস্যুতায় যোগ দিয়েছি। দস্যুতা জীবন ছিল অনেক কষ্টের। প্রতিপক্ষ অপর দস্যু এবং কখনো আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ যাবে এমন আতংকে তাদের দিনরাত কেটেছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে এমনটি স্বপ্নেও ভাবেনি আনোয়ারুল। তাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা আছে তা প্রত্যাহারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তিনি।
২০১৬ সালের ৩১ মে আত্মসমর্পণ করা মাস্টার বাহিনী প্রধান মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাস্টার জানান, জীবনে পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারবো এমনটি ভাবিনি। আত্মসমর্পণ করে এখন স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুখে-শান্তিতে আছি। বাগেরহাটে মোটরসাইকেল সার্ভিসিংয়ের কাজ করে যে টাকা আয় হয় তা দিয়েই ভালোভাবে সংসার চলছে।
তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনে দস্যুতা জীবন ছিল অনেক কষ্টের। যারা আত্মসমর্পণ করে স্বভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে তারা কেউ আর দস্যুতায় ফিরে যাবে না। তাদের মতো মানুষের হাতে যারা অস্ত্র তুলে দিয়ে দস্যু বানিয়েছে সেই সব ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার দাবি কাদের মাস্টারের।
আত্মসমর্পণ করা দাদাভাই বাহিনীর সদস্য বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার শ্রীফলতলা গ্রামের কামাল শিকারীর স্ত্রী নুরানী বেগম জানান, আগে এক সময় তাকে গ্রামের মানুষ দস্যুর স্ত্রী বলে উহাস করতো। স্বামী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসায় এখন তারা ভাল আছে।
আত্মসমর্পণ করা আলিম মৃধার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে শাহানাজ আখিঁ জানান, আমার সহপাঠিরাও আগে আমাকে দস্যুর মেয়ে বলে ডাকতো। মনে অনেক কষ্ট ছিল। বাবাকে ছাড়াই তাদের বড় হতে হয়েছে। বাবা আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসায় ওই নামটি ঘুচিয়েছে। এখন তারা অনেক অনেক খুঁশি। বাবা আত্মসর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারায় আখিঁ প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
বিভিন্ন সুত্র জানায়, সুন্দরবনের যে সব দস্যুরা আগে আতœসমর্পণ করেছে তারা এখন স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। কেই মৎস্যঘের, রাজমিস্ত্রী এবং কেউ ইজিবাইক চালিয়ে অর্থ রোজগার করছেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সাবেক ওই সব দস্যুরা এখন তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছেন।
বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট একে আজাদ ফিরোজ টিপু জানান, সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়াটা আনন্দের সংবাদ। আর যেন কেউ সুন্দরবনে দস্যুবৃত্তি করতে না পারে এজন্য আইনশৃংখলা রক্ষাকারিবাহিনীর সদস্যদের সচেষ্ট থাকতে হবে।
বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, দস্যুরা সুন্দরবনে জেলে-বাওয়ালীদের অপহরণের পাশাপাশি বাঘ ও হরিণসহ বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী শিকারের সাথে জড়িত ছিল। বনরক্ষীরাও দস্যুদের আতংকে ছিল। সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ায় বাঘ ও হরিণসহ বন্যপ্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং বন থেকে সরকারের রাজস্ব বাড়বে বলে তিনি জানান।