পিরোজপুরের নাজিরপুর ও নেছারাবাদ উপজেলার কিছু এলাকা প্রায় সারাবছরই জলাবদ্ধতার কারণে কচুরিপানা ভরা থাকে। আর এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে প্রায় বছরজুড়েই এখানে চলে ভাসমান সবজি চাষ ও চারা উৎপাদনের মহোৎসব। কিন্ত মহামারি করোনা ও লকডাউনের কারণে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে এ ভাসমান সবজির চাষীরা।
প্রতি বছর যেভাবে এখানে উৎপাদিত চারার যে দাম পাওয়া যেত বর্তমানে চারার দাম অনেকটাই কম এবং মহাজনদের থেকে নেয়া চড়া সুদের দাদনের টাকা নিয়ে মন্দা বিক্রির কারণে হিমশিম খাচ্ছে ভাসমান সবজি চাষীরা।
জেলা কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের মতে, প্রায় শত বছরের বেশি সময় ধরে পিরোজপুরের নাজিরপুর ও নেছারাবাদে ভাসমান সবজির চাষাবাদ করে আসছে চাষীরা। জেলার নাজিরপুর উপজেলায় ১২০ হেক্টর জমিতে এবং নেছারাবাদ উপজেলায় ৩৭ হেক্টর নিচু জমিতে ধাপের উপরে ভাসমান ভাবে সবজি ও চারার আবাদ করা হয়।
এই দুই উপজেলায় প্রায় ৩২০০ জন চাষী ভাসমান সবজি চাষের সঙ্গে জড়িত। কচুরিপানার ধাপ তৈরি হলেই সেসব ভাসমান ধাপের উপরে বীজতলায় কোনটায় পেঁপে, লাউ, কুমড়া, শিম, বরবটি; আবার অন্যগুলো টমেটো, বেগুন, করলা, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সবুজ ফুলকপি ও শসার চারা উৎপাদন এবং লাউশাক, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক বা সাদা শাকের চাষও করেন চাষীরা।
সম্ভাবনাময় এই কৃষিক্ষেত্রে সরকারি কোন সহযোগিতা না থাকার ফলে অনেকটাই হতাশ এ এলাকার চাষীরা। জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ দেশের পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা হয় এ ভাসমান সবজি চারা।
চলতি বছরে করোনা মহামারির ফলে সবকিছু বন্ধ থাকায় চাষীরা বিভিন্ন মহাজনদের থেকে চড়া সুদে লোন নিয়ে চাষাবাদ করেছে। কিন্ত মৌসুম শুরু হলেও চারার বাজার ব্যাপক মন্দা যাচ্ছে। তেমনি আগের মত আগ্রহ নেই ক্রেতাদের মধ্যে ফলে বিপাকে পড়েছে ভাসমান সবজি চাষীরা।
এবছরে দুই উপজেলা মিলে মোট ১৫৭ হেক্টর জমিতে ৮৬ লাখ ৫০ হাজার চারা উৎপাদন হওয়ার কথা থাকলেও, চারা নিয়ে ভালো দাম না পাওয়ায় হতাশ ভাসমান চাষীরা।
ভৌগোলিকভাবেই পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ী-দোবড়া, কলারদোয়ানিয়া ও মালিখালী এবং নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা সারাবছর ৫-৮ ফুট পানিতে ডুবে থাকে।
ফলে সেখানে কোন প্রকার চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। রবি, খরিপ-১ ও খরিপ-২ মৌসুমে বিভিন্ন ফসল চাষাবাদে চাষীরা ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ সুবিধা না পাওয়ায় স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বহুমুখী এ ফসল আবাদ করেও বেশিরভাগ সময় লাভের মুখ দেখেন না।
আবার এই সুদখোর মহাজনদের দাদন ব্যবসার জালে জড়িয়ে অনেক চাষী এখন সর্বশান্ত হওয়ার পথে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসলহানি, পণ্যের মূল্যহ্রাস, বাজারজাত করণে অসুবিধা ও সংরক্ষণ সুবিধার অভাব ইত্যাদি কারণে চাষীরা প্রতি বছর কাঙ্ক্ষিত লাভ পায় না, বরং মোটা লোকসানের কবলে পড়ে। যার অধিকাংশ কৃষক ভূমিহীন ও বর্গাচাষী। তাই এ পেশায় চাষীদের রক্ষায় প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা পাওয়া প্রত্যাশা স্থানীয় চাষীদের।
স্থানীয় চাষী জামাল হোসেন জানান, জমি বর্গা নিয়ে ভাসমান সবজির চাষাবাদ করছি। এই জমিতেই গড়ে তোলা হয়েছে ভাসমান সবজির খেত। ভাসমান অবস্থায় তৈরি হয় বেড বা ধাপ। আমার নিজের চাষ করার মতো ১৫/১৬ টি ধাপ আছে। সিম, পেঁপে, টমেটো, মরিচ ও লাউসহ বিভিন্ন সবজির চাষ হয় এখানে। ৬০ হাত একটি বেড কিনে আনলে কৃষাণ খরচসহ ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয় প্রতি বেডে। করোনার কারণে ব্যাপারীদের আসা যাওয়া না থাকায় এ বছর দাম ভালো পাচ্ছিনা।
পিরোজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. নজরুল ইসলাম সিকদার জানান, নাজিরপুর উপজেলার গাওখালী, মনোহরপুর, দেওলবাড়ি ও মালিখালী এই সমস্ত জায়গাগুলোতে সাধারণত দেখা যায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কৃষক এই ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষের সঙ্গে জড়িত। আমরা এসব কৃষকদের চাষাবাদের মান রক্ষার্থে পরামর্শ ও চাষীদেরকে উদ্বুদ্ধকরণ, ভ্রমণ, বিভিন্ন পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার জন্য চাষিরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। তা নাহলে এই চাষ পদ্ধতিতে কতদিন টিকিয়ে রাখা যাবে সেটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে।