প্রতিনিয়ত ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি, খেতখামার ও বসতভিটা। দিনকে দিন ভিটেমাটি হারানো মানুষের সংখ্যাও প্রতিদিন বাড়ছে।
সম্প্রতি নতুন করে নদীভাঙন দেখা দেয়ায় জায়গা-জমি, সহায়-সম্বল হারিয়ে পাশের জেলা সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, এমনকি প্রতিবেশি দেশ ভারতে ঠাঁই নিয়েছেন অনেকেই। কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর ভাঙনের স্থায়িত্ব দীর্ঘকাল হওয়ায় উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের প্রাকৃতিক দৃশ্যপট একেবারেই পাল্টে গেছে বলা চলে। একই অবস্থা কয়রা সদর ও মহারাজপুর ইউনিয়নেরও। উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটমারচর, হাজতখালী, কাশিরহাট খোলা, গাজীপাড়া, কয়রা সদর ইউনিয়নের হরিণখোলা, ২নং কয়রা, গোবরা, ঘাটাখালী ও মহারাজপুর ইউনিয়নের দশাহলিয়া এলাকা সরেজমিনে ঘুরে এমন চিত্রই চোখে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবশেষ চলতি বছরের ২০ মে সুপার সাইক্লোন আম্পানের তান্ডবে বাঁধ, ঘর-বাড়ি সব তছনছ হয়ে যায়। উপজেলার ২১টি স্থানে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এর মধ্যে প্রথম দিকে ৯টি স্থান ভেঙে কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। পরে আরও ৫টি স্থান ভেঙে যায়। এতে ৪২টি গ্রাম প্লাবিত হয়। ৫১ হাজার ঘরবাড়ি ও ১ লাখ ৮২ হাজার মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এর আগে, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাতের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে উপজেলার প্রায় ১৬ হাজার পরিবার বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রে, ৬০ শতাংশ দেশের বিভিন্ন শহরে ও বাকি ৩০ শতাংশ পাশের দেশ ভারতে চলে গেছে। বারবার নদী ভাঙনে এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা রবিউল ইসলাম জানান, বারবার নদীভাঙনে সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে কর্মহীন হয়ে জীবিকার সন্ধানে যৌথ পরিবারের মায়া ছেড়ে পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন ও লবণাক্ততার কারণে রবিউলের মতো নিঃস্ব হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। উপজেলার মুসা গাইন, রমেশ, করিম গাজীও ভিটেমাটি ছেড়ে কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে গেছেন।
আলতাফ হোসেন নামে আরেকজন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সিডর-আইলার পর থেকে লবণাক্ততা সমস্যা শুরু। তারপর থেকে সমস্যা শুধু বেড়েই চলেছে। লবণ-পানি খাওয়ার কারণে শরীরে চুলকানি, চর্মরোগসহ দেখা দিচ্ছে নানা অসুখ। এসব কারণেই মানুষ এলাকা ছাড়ছেন।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘যত দিন যাচ্ছে নদীতে পানি ধারণক্ষমতা ততই কমছে। নদীর তলদেশে পলি জমে তার গভীরতাও কমে যাচ্ছে। ফলে একটু বৃষ্টি হলেই পানি উপচে পড়ছে। নদীর পাড় ভাঙছে। তাছাড়া আমাদের নদী এখন দিক পরিবর্তন করছে। নদীতীরবর্তী মাটি খুব ভঙ্গুর। এতে সামান্য একটু পানির চাপেই তা ভেঙে পড়ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় নদীকে মুক্ত করতে হবে। নদীতে জোয়ার বাঁধের (টিআরএম) ব্যবস্থা করতে হবে।’
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আম্পানে এখানকার অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। এসব পরিবারকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সবার আগে উপকূলীয় অঞ্চলটির জন্য দরকার টেকসই একটি বেড়িবাঁধ।’