বিদায়ী বছরে ৮টি উদ্যোক্তাবান্ধব গবেষণা সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি)। এসব গবেষণা মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করে দেশের চাকরির বাজারের অস্থিতিশীল চাপ কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।
অপ্রচলিত ডাল জাতীয় ফসল থেকে মুখরোচক খাবার তৈরি, সাশ্রয়ী মূল্যে উদ্ভাবিত ধানের ড্রায়ার মেশিন, বিলুপ্তপ্রায় ও উচ্চফলনশীল মাছের শুক্রাণু দীর্ঘদিন সংরক্ষণ, নতুন বিদেশি উচ্চ ফলনশীল ফল, স্বল্পমূল্যে পনির উৎপাদন, উচ্চ ফলনশীল মিষ্টি আলু, পতিত জমিতে উচ্চ ফলনশীল ও ব্যাপক সম্ভাবনাময় কাসাভা আলু, মাছের ফেলে দেয়া ত্বক থেকে জেলাটিন নিষ্কাশন- বিদায়ী বছর ২০২৩ জুড়ে বাকৃবির গবেষকদের উদ্যোক্তাবান্ধব গবেষণাসমূহ ।
আরও পড়ুন: বিষণ্ণতায় ভুগছেন ৭৪ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থী: গবেষণা
অড়হর ডাল থেকে মুখরোচক খাবার তৈরি
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পশুখাদ্য, জ্বালানি, বেড়া, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিসহ নানা কাজে অড়হর ডাল ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশেও এটি অপ্রচলিত একটি খাবার। বাকৃবির ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ছোলায়মান আলী ফকির তার দীর্ঘদিনের গবেষণায় অড়হর থেকেই ৭ ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি করেছেন। খাবারগুলো হলো অড়হর পুরি, অড়হর সিঙ্গারা, অড়হর রুটি, সেদ্ধ কাঁচা বীজের পেস্ট দিয়ে হালুয়া ও কাবাব, অড়হর বীজ ভাজা ও কাঁচা বীজের সবজি। উচ্চ মাত্রায় আঁশ, কম মাত্রায় শর্করা ও চর্বিযুক্ত হওয়ায় এটি হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে, ওজন কমাতে, হজমশক্তি বাড়াতে এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উত্তম খাবার হিসেবে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। হেক্টর প্রতি ৪০০ থেকে ৮০০ কেজি ফলন পাওয়া যায়। ফসল লাভের পর অড়হর গাছ ও পাতা জ্বালানি, বেড়া, পশুখাদ্য ও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা যাবে।
বাকৃবি গবেষকদের ধান ড্রায়ার ও হারমেটিক ব্যাগ উদ্ভাবন
২০১৫ সালে বাকৃবির কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মঞ্জুরুল আলমের নেতৃত্বে গবেষণাটি শুরু হয়। সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে এখন পর্যন্ত ২৫০টির বেশি ড্রায়ার ব্যবহৃত হচ্ছে। এ যন্ত্রের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় কিংবা যে কোনো পরিবেশে ৩-৪ ঘন্টায় ৫০০ কেজি ধান শুকানো যায়। আমদানিকৃত রাইস ড্রায়ারের এক-পঞ্চমাংশ দামেই বাকৃবি উদ্ভাবিত ড্রায়ারটি পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া ধান ও বীজ সংরক্ষণে হারমেটিক ব্যাগ উদ্ভাবন করা হয়েছে। সনাতন পদ্ধতিতে ধান সংরক্ষণে ৬ শতাংশ অপচয় হয়। বায়ুরোধী হারমেটিক ব্যাগ ব্যবহারে তা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। এই ব্যাগ ব্যবহারে ধান বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা প্রায় ৯০ শতাংশ বজায় থাকে।
বাকৃবির গবেষকদের মাছের শুক্রাণু সংরক্ষণে সাফল্য
ক্রায়োপ্রিজারভেশনের মাধ্যমে -১৯৬° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মাছের শুক্রাণু সংরক্ষণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন বাকৃবির গবেষকদল। বাকৃবির ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম সরদার ও যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির এগ্রিকালচারাল সেন্টারের অ্যাকুয়াটিক জার্মপ্লাজম অ্যান্ড জেনেটিক রিসোর্স সেন্টারের অধ্যাপক ড. টেরেন্স টিয়ার্সের নেতৃত্বে এ গবেষণাটি সম্পন্ন হয়। দেশে বাণিজ্যিকভাবে প্রথমবারের মতো বিভিন্ন হ্যাচারিতে এই পদ্ধতিতে পোনা উৎপাদন করা হয়েছে। ক্রায়োপ্রিজারভেশনের মাধ্যমে উৎপাদিত মাছের কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই এমনকি গুনাগুনও অক্ষুণ্ণ থাকে।
বিদেশি ফল ল্যাংসাটঃ সম্ভাবনার নতুন দুয়ার
বাকৃবির জার্মপ্লাজম সেন্টারের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ও বাকৃবির উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এম এ রহিম প্রায় দেড়যুগ আগে থাইল্যান্ড থেকে জার্মপ্লাজম সেন্টারে ল্যাংসাটের চারা নিয়েন আসেন। দীর্ঘ গবেষণার পর চারাগাছগুলোকে এদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া হয়েছে। দেখতে লটকনের মতো ফলটি খেতে অনেকটা লিচু ও আঙ্গুরের মাঝামাঝি স্বাদের। একটি পরিণত গাছে বছরে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কেজি ফল ধরে। এক একটি ফলের ওজন হয় প্রায় ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম। বিদেশি এই ফলটি দ্রুতই দেশের ফলের বাজারে স্থান দখল করে নেবে বলে জানান জার্মপ্লাজমের গবেষকদল।
পনির গবেষণায় বাকৃবির গবেষকদের সাফল্য
বাকৃবির ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আশিকুল ইসলাম ও তার গবেষকদল দেশি বিদেশি বিভিন্ন জাতের চিজ তৈরি করেছেন। প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে ও ভিন্ন পদ্ধতিতে চিজ তৈরি করে সফলতা পেয়েছেন। তাদের উদ্ভাবিত চিজের মধ্যে রয়েছে দেশীয় অষ্টগ্রাম চিজ, মোজারেলা চিজ, বিদেশি চেডার চিজ ও প্রসেসড চিজ। প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে উদ্ভাবনের এ পদ্ধতিতে প্রতিকেজি দুধ থেকে বেশি পরিমাণে চিজ আহরণ করা যায়।
আরও পড়ুন: গবেষণায় ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড পেলেন শাবিপ্রবির ৪ গবেষক
উচ্চফলনশীল বাউ মিষ্টি আলু-৫ উদ্ভাবন
বাকৃবির কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম আরিফ হাসান খান রবিনের নেতৃত্বে উচ্চফলনশীল বাউ মিষ্টি আলু-৫ উদ্ভাবন করেছেন তার গবেষক দল। সাধারণ মিষ্টি আলু হেক্টর প্রতি ফলন দেয় প্রায় ১০ দশমিক ২৫ টন। উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে বাকৃবি উদ্ভাবিত আলু ফলন দিয়েছে হেক্টর প্রতি প্রায় ৩০ টন। ১০০-১১০ দিন বয়সের গাছ থেকে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যায়।
ধান ও গমের বিকল্প হিসেবে শিমুল আলু বা কাসাভা
বাকৃবির ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ছোলায়মান আলী ফকির ও তার গবেষক দল কাসাভা বা শিমুল আলু নিয়ে সফল গবেষণা করেছেন। সম্প্রতি কাসাভা আলু থেকে ১৩ ধরনের মুখরোচক ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার, আটা, স্টার্চ ও পশুখাদ্যের মতো উপাদান তৈরি করা হয়েছে। অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এই আলু অনাবাদি ও পতিত জমিতে ন্যূনতম পরিচর্যায় উচ্চ ফলন পাওয়া সম্ভব। প্রতি হেক্টরে প্রায় ৯ থেকে ১০ হাজার গাছ লাগানো যায় এবং প্রায় ৫০ টন ফলন লাভ করা সম্ভব।
মাছের ত্বক থেকে মূল্যবান জেলাটিন নিষ্কাশন
বিভিন্ন দেশীয় মাছের ত্বক থেকে জেলাটিন নিষ্কাশন করেছেন বাকৃবির ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইসমাইল হোসেন ও তার গবেষক দল। জেলাটিন সরাসরি ব্যবহার করা যাবে খাদ্য ও ঔষধ শিল্পে। জেলাটিন দিয়ে বিভিন্ন স্বাদের আইসক্রিম, পুডিং ও ক্যান্ডি তৈরি করা যায়।
গবেষণায় জানা গেছে পাঙ্গাস, সামুদ্রিক পোয়া, বাইন, শোল মাছসহ যে কোনো মাছের ত্বক থেকে জেলাটিন নিষ্কাশন করা সম্ভব। এ প্রযুক্তি ব্যবহারে নিষ্কাশিত জেলাটিন বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। বাণিজ্যিকভাবে মাছের ত্বক থেকে জেলাটিন নিষ্কাশন করা হলে বিদেশ থেকে জেলাটিন আমদানির খরচ কমানোর পাশাপাশি মাছের ফেলে দেওয়া বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা করাও সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন: টেকসই উন্নয়নে উচ্চতর গবেষণা পরিচালনার আহ্বান ইউজিসি চেয়ারম্যানের