ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে পুরো পৃথিবীটা ভ্রমণকারীদের জন্য নিরাপদ জায়গা। হোক সেটা নিজের দেশে অথবা বিদেশে। প্রতিটি মানুষ তার নিজের আবাসস্থলকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। তাই কোন বহিরাগতকে দেখলে যারপরনাই খুশি হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠের মত অনেক অনর্থও ঘটতে পারে এই ভ্রমণের সময়। প্রতি ঈদের মত এবারো ঢাকা ছাড়ছে অজস্র মানুষ। কেউ প্রস্তুতি নিচ্ছে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার, কেউ বা প্ল্যান করছে পরিবার নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসার। উভয় ক্ষেত্রেই একটু স্মার্ট চিন্তার অভাবে বহু প্রত্যাশিত ভ্রমণটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই ভ্রমণের পূর্ব প্রস্তুতি সহ চলুন জেনে নিই ঈদের ছুটিতে নিরাপদে ভ্রমণের কিছু দরকারি টিপ্স।
ঈদের ছুটিতে ভ্রমণের পূর্ব প্রস্তুতি
গন্তব্য সুনির্দিষ্টকরণ
বেড়াতে যাওয়ার আগে সর্বপ্রথম ঠিক করতে হয় গন্তব্য। আর এর উপর নির্ভর করেই পরবর্তীতে নির্ধারিত হয় ভ্রমণের সময়, বাজেট, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি। গত বছরের ন্যায় এবারের ঈদও বেশ গরমের মধ্যেই পড়তে যাচ্ছে। তাই যে জায়গাগুলোতে অত্যধিক কায়িক পরিশ্রম হবে সে জায়গাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া উত্তম। যেমন-পাহাড় ও ঘন বনাঞ্চলের স্থলে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে সাগর, নদী, হাওড় এবং হালকা গাছ-গাছালি ঘেরা উদ্যান বা এরকম কোন খোলামেলা জায়গা।
যে জায়গাটিকে গন্তব্য হিসেবে ঠিক করা হবে তার ব্যাপারে স্থানীয় বা আগে কেউ সেখানে গেছে এরকম কারো কাছ থেকে তথ্য নেয়া উত্তম। এছাড়াও এখন সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের যুগে ভ্রমণ বিষয়ক বিভিন্ন পরিচিত-অপরিচিত জায়গাগুলোর তথ্য অনায়াসেই পাওয়া যায়।
পড়ুন: ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে কোথায় ঘুরতে যাবেন?
পরিবহন ব্যবস্থা বাছাই
প্রতি ঈদে বাড়ি গ্রামের বাড়ি যাওয়া এবং ঢাকার বাইরে পরিজন নিয়ে ঈদের ছুটি কাটানো উভয়ের ক্ষেত্রেই পরিবহন ঠিক করা বেশ ঝামেলার কাজ। বিশেষ করে যারা মাঝারি ধরনের পাবলিক পরিবহনগুলোতে যাতায়াত করে থাকেন, তাদের জন্য এই সময়টা রীতিমত বিভীষিকাময়। প্রতি ঈদে পরিবহনগুলোর সিট বুকিংয়ের লাইনে প্রচুর মানুষের ভীড়ে হাজারো ঝামেলা পোহাতে হয়। তাই টিকেট ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যত আগে সম্ভব সিট বুক করে নেয়া উত্তম।
তাছাড়া প্রত্যহ যানজট অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পাবার ফলে স্থলপথে যাতায়াত এখন সমূহ হয়রানির নামান্তর। তাই যারা শুধুমাত্র প্রমোদ ভ্রমণে ঢাকা ছাড়ছেন তাদের জন্য ঈদের দিন দিবাগত রাত বা পরদিন রওনা হওয়া ভালো। এছাড়া একই গন্তব্যের যাত্রীরা ৬ থেকে ৭ জন হলে একসাথে একটা মাইক্রো বাস ভাড়া করেও যাওয়া যায়। বড় গ্রুপের পর্যটকরাও এভাবে ঈদের মৌসুমে যে কোন সময় যাতায়াত করতে পারেন।
থাকা-খাওয়ার পূর্ব পরিকল্পনা
ঈদের ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এই বিষয়টি নিয়ে আগে থেকেই ভেবে রাখা ভালো। কি ধরনের আবাসিক হোটেল ঠিক করা হচ্ছে, সাথে বা আশেপাশে খাবারের হোটেল আছে কিনা প্রভৃতি ব্যাপারগুলো ঢাকা থেকেই ঠিক করে যাওয়া উচিত। বিশেষ করে ২ থেকে ৩ দিনের ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভ্রমণ সঙ্গীদের সাথে আলোচনা করে বাজেট অনুযায়ী একটি উপযুক্ত লোকেশানে আবাসন ঠিক করতে হবে।
পড়ুন: ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য ঢাকার কাছাকাছি সেরা কয়েকটি রিসোর্ট
এই লোকেশান থেকে খাবারের হোটেল এবং দর্শনীয় স্থানসমূহের দূরত্বের ব্যাপারটা খেয়াল রাখতে হবে। কেননা এই বিষয়টি বাজেটের উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। যেহেতু ঈদের সময় যাওয়া হচ্ছে সেহেতু অত্যধিক হোটেল ভাড়া বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে।
অভিজতা রেস্টুরেন্ট এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। এক্ষেত্রে স্থানীয় কারো থেকে অথবা ট্রাভেল ব্লগগুলোর মাধ্যমে খাবার খরচের ব্যাপারে জেনে নেয়া যেতে পারে।
ভ্রমণের জন্য ব্যাগ গোছানো
এই গোছগাছের ব্যাপারটির সঙ্গে কি ধরনের জায়গায় যাওয়া হচ্ছে এবং কতদিন থাকতে হবে তা জড়িত। যারা বাড়িতে ঈদ করতে যান তাদের লাগেজটা স্বভাবতই একটু বড় হয়। আর পর্যটকদের জন্য বেশ মাপজোখ করেই ব্যাগ গোছাতে হয়। উভয় ক্ষেত্রেই যতটা সম্ভব অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাদ দেয়া উচিত। চলুন, দেখে নেয়া যাক ব্যাক-প্যাকের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী।
পড়ুন: ঢাকার কাছেই প্রকৃতির মাঝে ক্যাম্পিং সাইট
টাকা-পয়সার ব্যবস্থাপনা
নির্ধারিত বাজেটের থেকে কিছুটা বাড়িয়ে টাকা-পয়সা নেয়া উচিত। ক্রেডিট বা ডেভিট কার্ডধারীদেরও সাথে ক্যাশ টাকা রাখতে হবে। এমনকি ছোট ছোট ভাংতিও প্রস্তুত রাখতে হবে। মোবাইলে বেশি করে রিচার্জ করা অথবা বিকাশ বা নগদে টাকা ভরে নেয়া যেতে পারে।
প্রয়োজনীয় পরিধেয়
যেহেতু গরমের ঈদ, তাই সাদা বা হালকা রঙের কাপড়ই শ্রেয়। সদ্য কেনা জুতা ব্যবহার করা যাবে না, কেননা মাঝ রাস্তায় পায়ের আঙ্গুলে ঠোসা পরে বেকায়দায় ফেলে দিতে পারে। ভ্রমণের জন্য স্পোর্ট্স ট্রাওজারের সাথে শক্ত গ্রিপ সহ কেড্স ভালো। গ্যাবাডিং বা জিন্স পড়া যেতে পারে তবে খেয়াল রাখতে হবে প্রচন্ড গরমের সময় কাপড় যেন বেশি আঁটসাঁট না হয়।
কিছু ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস
যে কোন ধরনের মোবাইল ফোনের ব্যবহারকারিদের জন্য চার্জার এবং পুরো চার্জ দেয়া পোর্টেবল চার্জার নেয়া আবশ্যক। বাসা থেকে বেরনোর আগে মোবাইল ফোনে পুরো চার্জ দিয়ে নেয়া জরুরি। এছাড়া সাথে নেয়া ক্যামেরার ক্ষেত্রেও ব্যাটারি ফুল চার্জ দিয়ে নিতে হবে। ক্যামেরা ঠিকমত কাজ করছে কিনা সেটাও একবার দেখে নেয়া উচিত।
পড়ুন: হিমাচল, জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ ভ্রমণ: দর্শনীয় স্থান ও খরচ
ঈদেভ্রমণে দুর্ঘটনা এড়াতে সতর্কতা
ভ্রমণ পথ ও গন্তব্যের ব্যাপারে যথাযথ তথ্য নেয়া
যে কোন গন্তব্যে যাওয়া আগে তার ব্যাপারে যত বেশি জেনে নেয়া যায় ততই ভালো। প্রথমেই সেখানকার আবহাওয়া এবং আইনশৃঙ্খলার অবস্থা জেনে নিতে হবে। নিকটস্থ থানা, হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্সের নাম্বার, আবাসিক হোটেল, এবং ভ্রমণকারির যে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে তার শাখা লোকেশন ও যোগাযোগ নাম্বার মোবাইলে সংরক্ষণ করতে হবে।
এছাড়া যে রুট ব্যবহার করে গন্তব্যে পৌছবে সে রুটেও কোন ঝামেলা চলছে কিনা আগে থেকেই যাচাই করে নিতে হবে। মোবাইলে নূন্যতম একদিনের ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে নেয়া যেতে পারে। এতে করে যাত্রাপথে যে কোন জায়গায় নিকটস্থ অ্যাম্বুলেন্স ও থানার নাম্বার খুঁজে বের করা যাবে।
নিকট বন্ধু ও আত্মীয়দের জানিয়ে রাখা
বাড়িতে বাবা-মার সাথে ঈদ করার জন্য ঢাকার ছাড়ার সময় ঢাকার অন্তত একজন নিকট আত্মীয় বা বন্ধুকে প্রস্থানের বিষয়টি জানিয়ে রাখা উচিত। সেই সাথে রওনা হওয়া সময়টিও জানাতে হবে গন্তব্যের লোকদের। বিশেষত পৌছতে গভীর রাত হয়ে গেলে তারা যেন গাড়ির ব্যবস্থা করতে সহায়তা করতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় গ্রামের বাড়িটি বাস বা ট্রেন ষ্টেশন থেকে অনেক ভেতরে।
একই কথা খাটে যারা প্রতিনিয়ত ঢাকাতে ঈদ করেন তাদের জন্যও।
পড়ুন: কলকাতা ভ্রমণ: দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার উপায় ও খরচ
ওষুধপত্র ও ফার্স্ট এইড বক্স সঙ্গে রাখা
যাত্রাপথে বা গন্তব্যে পৌছে বিভিন্ন সময় ছোট-খাট দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই চট জলদি প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ফার্স্ট এইড কিট সঙ্গে রাখা জরুরি। জ্বর, বমি, মাথা ব্যথা, পেট খারাপের ওষুধ এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে অ্যান্টিবায়োটিক সাথে রাখা জরুরি। সাথে নেয়া যেতে পারে মশা নিরোধক ওডোমোস। সাথে বাচ্চা থাকলে তাদের স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
সাথে খাবার পানীয় নেয়া
ভয়াবহ দাবদাহে ঈদ উৎসবে শক্ত সমর্থ থাকতে বিশুদ্ধ পানি পানের কোন বিকল্প নেই। শুধু দীর্ঘ মেয়াদের ভ্রমণেই নয়; রোদের মধ্যে ঘন্টাখানেক হাটার ক্ষেত্রেও সাথে পানি বা জুসের বোতল বহনে অভ্যস্ত হওয়া উচিত।
ভ্রমণের সময় খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা
ভ্রমণের সময় খাবারের মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে খাবারটি কিভাবে প্রস্তুত হচ্ছে তা দেখা জরুরি। কিন্তু সেটা সম্ভব না হলে খাবারটি যথেষ্ট রান্না হয়েছে কিনা সেদিকে নজর দিতে হবে। কোন খাবারে অ্যালার্জি থাকলে সেটি সেখানকার বিখ্যাত খাবার হলেও এড়িয়ে যাওয়া উচিত। ব্যাকটেরিয়া থেকে দূরে থাকতে শুধুমাত্র যেগুলো খোসা ছাড়িয়ে খেতে হয় সে ফলগুলো খাওয়া যেতে পারে।
পড়ুন: নেপাল ভ্রমণ: শত বছরের তীর্থস্থান ঘুরতে হিমালয়ের দেশে
ভ্রমণের পূর্বে পর্যাপ্ত ঘুম
ভ্রমণের সময় দীর্ঘ দূরত্ব না থাকা সত্ত্বেও প্রায়ই যানজটের জন্য দীর্ঘক্ষণ রাস্তাতেই কেটে যায়। এমতাবস্থায় শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে শক্তির যোগানের জন্য ভ্রমণের পূর্বে পর্যাপ্ত ঘুম দরকার। এছাড়াও ট্রেনে মোশন সিকনেস থেকে রক্ষা পেতে যানবাহন চলাকালে অল্প কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রাখা অথবা সম্ভব হলে ঘুমিয়ে নেয়া ভালো।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
শুধু এই ঈদের জন্য নয়; দেশের ভেতরে যে কোন ভ্রমণকালে জাতীয় পরিচয়পত্র সাথে থাকা উচিত। বর্তমানে করোনা টিকা কার্ডও একটি অবিচ্ছেদ্য সংযোজন হয়ে দাড়িয়েছে। এগুলোর প্রতিটির স্ক্যান কপি অনলাইনে তথা- ড্রপবক্স, গুগল ড্রাইভ, ওয়ান ড্রাইভ অথবা অফলাইনে মোবাইলের ফাইল ম্যানেজারে সংরক্ষণ করা উচিত, যেন মোবাইলের মাধ্যমে দ্রুত দেখা যায়।
শেষাংশ
যারা নিয়মিত ভ্রমণ করেন তাদের জন্য ভ্রমণের এই পূর্ব প্রস্তুতি ও সতর্কতাগুলো অবচেতন মনের কিছু কার্যকলাপের মত। নতুন ভ্রমণকারিদেরও প্রতিবার ভ্রমণে এই পদ্ধতিগুলো চর্চার মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। এতে করে নিজের নিরাপত্তার পাশাপাশি ভ্রমণসঙ্গীরও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায়। সর্বোপরি, ঈদের ছুটিতে ভ্রমণের প্রস্তুতি, সতর্কতা ও নিরাপত্তা অব্যাহত থাকলে চির স্মরণীয় এক ভ্রমণ অভিজ্ঞতার আশা করা যায়।
পড়ুন: সীতাকুণ্ড ডে ট্যুর: একদিনে ঘুরে আসুন চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মহামায়া লেক