একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-সভ্যতার অগ্রগতি জানার জন্য জাদুঘর একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক জাদুঘরগুলোও যেন ঠিক সেভাবেই ধরে রেখেছে পুরো বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যকে। শুধু তাই নয়, দর্শনীয় স্থান হিসেবেও ঢাকার জাদুঘরগুলো অনন্য। নতুন প্রজন্ম এই জায়গাগুলোতে বিচরণের মাধ্যমে শত বছরের বাংলাকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারে। তাই ঢাকার শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্প সময়ের শিক্ষাসফরের জন্য এর জাদুঘরগুলো হতে পারে উপযুক্ত স্থান। চলুন, জেনে নেয়া যাক ঢাকার কয়েকটি সেরা জাদুঘরের ব্যাপারে।
বাংলাদেশের ইতিহাস সমৃদ্ধ ঢাকার সেরা ১০টি জাদুঘর
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, শাহবাগ
প্রাক-ইতিহাস থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম জাদুঘরগুলোর মধ্যে অন্যতম এই চমৎকার সংগ্রহশালাটি। এটি পাথর, ধাতু ও কাঠের ভাস্কর্য, সোনা, রুপা ও তামার মুদ্রা, পোড়ামাটির নিদর্শন এবং অন্যান্য পুরাকীর্তিতে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ১৯১৩ সালের ২০ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ঢাকা জাদুঘর’ নামে। ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট বাংলার তৎকালীন গভর্নর থমাস গিবসন-কারমাইকেল আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেছিলেন। ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে এটি ঢাকার নায়েব-নাজিমের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালের ১৭ নভেম্বর এর নাম ‘বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর’ দেয়া হয়।
আরও পড়ুন: বর্ষাকালে বাংলাদেশের সেরা ১০টি ভ্রমণ স্থান
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, ধানমন্ডি
ধানমন্ডি ৩২-এ অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনটি ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ নামে পরিচিত। এখানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবর রহমানকে তাঁর পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ হত্যা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এখান থেকেই ১৯৬২ সালের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন, এমনকি ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের রূপরেখাও তিনি তৈরি করেছিলেন এই বাড়ির কনফারেন্স টেবিলে।
১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ট্রাস্টের উদ্যোগে এই বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়।
স্বাধীনতা জাদুঘর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
এই দৃষ্টিনন্দন জাদুঘরটি মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করে। এছাড়াও এটি ১৬ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনামল থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা পর্যন্ত সমগ্র জাতির ইতিহাস প্রদর্শন করে। এটিই দেশের প্রথম এবং একমাত্র যাদুঘর,যা মাটির নিচে নির্মিত হয়েছে। জাদুঘরটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৬৭ একর কমপ্লেক্সের অংশ, যা আগে রমনা রেসকোর্স নামে পরিচিত ছিল।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের দশটি প্রাচীন মসজিদ: দেশের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন
জাদুঘরটি ২০১৫ সালের ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। জাদুঘরটির ওপরে ঠিক মাঝখানে আছে আলোর টাওয়ারটি, যা স্বাধীনতা স্তম্ভ নামে পরিচিত। প্রায় ৫০ মিটার উঁচু টাওয়ারটি কাচের প্যানেল দিয়ে তৈরি, যা সাধারণত রাতে আলোকিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, আগারগাঁও
১৯৭১-সালে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের এক বিরল সংগ্রহ এই জাদুঘর। প্রদর্শিত নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে যোদ্ধাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, অস্ত্র, মানুষের দেহাবশেষ, যুদ্ধ সম্পর্কিত নথি ও অন্যান্য সরঞ্জাম। স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ৪৫ বছর ধরে জাদুঘরটিতে ২১ হাজারেরও বেশি নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়েছে।
২০০৯ সালে জাদুঘরের নতুন ডিজাইনের জন্য একটি স্থাপত্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। এখানে স্থপতি তানজিম হাসান সেলিম ও নাহিদ ফারজানা তাদের নকশার জন্য প্রথম পুরস্কার জিতেছিলেন। এই নকশার ভিত্তিতেই ২০১৩ সালে আগারগাঁওয়ে নতুন ভবনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং নির্মাণকাজ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন প্রাঙ্গণ আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৭-এর ১৬ এপ্রিল উন্মুক্ত করা হয়।
আরও পড়ুন: ঢাকায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্থাপত্য ও ভাস্কর্য
আহসান মঞ্জিল, ইসলামপুর
ঢাকার নবাবদের অফিসিয়াল আবাসিক প্রাসাদ ও আসন ছিল এই আহসান মঞ্জিল। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এই ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৮৫৯ সালে, আর সম্পন্ন হয়েছিল ১৮৭২ সালে। বাংলাদেশের এই অন্যতম উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শনটি ইন্দো-সারাসেনিক রিভাইভাল স্থাপত্যে নির্মিত হয়েছিল। ভবনটির রাজকীয় সম্মুখ অংশটি বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে প্রশস্ত। নদীর ধারে এর খোলা প্রশস্ত সিঁড়ি বিশাল ত্রি-খিলানযুক্ত পোর্টালগুলো পর্যন্ত নিয়ে যায়। সিঁড়ির সামনের বাগানে একসময় একটি ফোয়ারা ছিল, যা আজ নেই। বিল্ডিংটির উত্তর ও দক্ষিণ পাশের বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে একটি খোলা বারান্দা।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জাদুঘর, আগারগাঁও
২০১৪ সালের অক্টোবরে ঢাকার জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় এই বিশেষ জাদুঘরটি। এখানে রয়েছে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া বিভিন্ন ধরনের বিমান ও যুদ্ধ সরঞ্জাম। বিএএফ (বাংলাদেশ এয়ারফোর্স) জাদুঘরে আছে চারটি প্রধান গ্যালারি। এর মধ্যে এয়ার ফোর্স গ্যালারিটিতে আছে কিছু স্মরণীয় ও ঐতিহাসিক ছবি। মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে আছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বিভিন্ন বছরের পদক ও ইউনিফর্ম নিয়ে রয়েছে গোটা একটি গ্যালারি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি সেনাদের মূল্য প্রদর্শনের জন্য সর্বশেষ গ্যালারিটির নাম ‘শান্তিরক্ষী কর্নার’। এগুলো ছাড়াও আছে ‘স্যুভেনির কর্নার’, যেখান থেকে জাতীয় বিমান বাহিনীর মনোগ্রামসহ পোস্টার, মগ ও টি-শার্ট কেনা যায়।
বিএএফ জাদুঘর স্থাপিত হয় ১৯৮৭ সালের ১৭ জুন। প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর এখানে তিন দিনব্যাপী আর্মি অস্ত্রশস্ত্রের শোসহ মিলিটারি মার্চ অনুষ্ঠিত হতো।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের সেরা ১০টি প্রাকৃতিক ঝর্ণা, জলপ্রপাত কোথায়? কীভাবে যাবেন?
জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর, আগারগাঁও
এই জাদুঘরটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি সংযুক্ত বিভাগ। ১৯৬৫ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের নির্বাহী আদেশে এটি গঠিত হয়।
জাদুঘরে বেশ কয়েকটি গ্যালারি রয়েছে, যেমন ভৌত বিজ্ঞান গ্যালারি, ফান সায়েন্স গ্যালারি, জৈবিক বিজ্ঞান গ্যালারি, প্রযুক্তিগত গ্যালারি, আইটি গ্যালারি ইত্যাদি।
এগুলো ছাড়াও রয়েছে একটি বিজ্ঞান পার্ক, একটি আকাশ পর্যবেক্ষণ, এবং একটি বিজ্ঞান গ্রন্থাগার। জাদুঘরটি বিভিন্ন ধরণের শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম যেমন- জনপ্রিয় বিজ্ঞান বক্তৃতা, বৈজ্ঞানিক চলচ্চিত্র শো এবং শিশুদের বিজ্ঞান উৎসব ইত্যাদির আয়োজন করে। তরুণ বিজ্ঞানীদের কাজের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে একক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘরটি।
আরও পড়ুন: ভ্রমণের উপকারিতা: দেশ বিদেশ ভ্রমণ আপনার মধ্যে কি পরিবর্তন আনতে পারে?
বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশের অবদানকে স্মরণার্থে নির্মিত এই জাদুঘর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। বাঙালি পুলিশ অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণের শিকার হয়ে রাইফেলসহ হাতের কাছে অন্য যা কিছু পেয়েছিলো তাই নিয়েই নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করে। অনেক পুলিশ সদস্য নিহত হন সেই রাতে।
দেশ স্বাধীনের বহু বছর পর ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় এই জাদুঘর। এতে থাকা বিভিন্ন উপকরণ ও প্রতীক যুদ্ধের সময় পুলিশ সেনাদের আত্মত্যাগকে চিহ্নিত করে। জাদুঘরের গবেষণা ইউনিট বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ কাউন্সিল চত্বরে নিহত একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে শনাক্ত করেছে।
টাকা জাদুঘর, মিরপুর
দেশের বিশিষ্ট শিল্পী, স্থপতি ও ইতিহাসবিদরা জাদুঘরটি চালু করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছেন। এই জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করতে বিভিন্ন উপায়ে দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও নোট সংগ্রহ করেছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। এখানে আছে পাল, সেন, গুপ্ত, সুলতানী, মুঘল ও ব্রিটিশ আমলের হাজার হাজার মুদ্রা ও নোট। বাংলাদেশ নিউমিসম্যাটিক কালেক্টরস সোসাইটি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা জাদুঘরে বিভিন্ন যুগের ১০০টি মুদ্রা হস্তান্তর করেছে।
আরও পড়ুন: ঢাকার সেরা ভাস্কর্যগুলো
ঐতিহাসিক এই সংগ্রহশালায় রয়েছে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ আমলের ৪৮টি মুদ্রা, নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহের ২৯টি, শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের চারটি, সিকান্দার শাহের পাঁচটি, গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের তিনটি, রুকুনউদ্দিন বারবক শাহের তিনটি, নাসিরুদ্দিন মাহমুদের দুটি, মাহমুদ শাহের একটি, শাহজাহানের একজন, বাদশা আলমগীরের দুইটি, ইসলাম শাহের একটি এবং শাহ আলমের যুগের একটি মুদ্রা।
বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর, শেরেবাংলা নগর
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে জনগণকে জানাতে সামরিক জাদুঘরটি উন্মুক্ত করা হয় ২০০৪ সালে। নভো থিয়েটারের পাশে অবস্থিত এই জাদুঘরটিতে জনসাধারণ বিনামূল্যে প্রবেশ করতে পারেন। বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর ১৬ ডিসেম্বর এবং ২৬ মার্চ ছাড়া অন্যান্য সরকারি ছুটিগুলোতে বন্ধ থাকে। হলের ভিতরে দুটি বড় কক্ষ রয়েছে এবং বাইরের মাঠে রয়েছে ২৬টি বিভিন্ন মডেলের ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য সাঁজোয়া যুদ্ধযান।
শেষাংশ
ঢাকার সেরা এই জাদুঘরগুলোতে ঘুরে বেড়ানোর সময় দর্শনার্থীদের কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। এগুলোর অধিকাংশতেই ছবি তোলা নিষেধ। তাই প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্মার্টফোন ব্যবহারও সীমিত করা হয়েছে। উচ্চস্বরে কথা বলা থেকে শুরু করে জাদুঘর প্রাঙ্গনে খাবার বা পানি নিয়ে প্রবেশ করার মত ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে। অধিকাংশ নিদর্শন কাঁচ দিয়ে ঘেরা থাকে। তবে উন্মুক্ত জিনিসগুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করা ঠিক নয়। এখানে অনেক বিদেশি দর্শনার্থীও ঘুরতে আসেন। তাদের সঙ্গে সৌজন্যমুলক ও সম্মানসূচক ব্যবহার করতে হবে। সর্বোপরি, এই ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো আমাদের দেশের সম্পদ।
আরও পড়ুন: বাঘা যতীন: যার বীরত্বে কেঁপে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য