দেশের হাসপাতালগুলোতে অপরিচ্ছন্নতা, খাবারের নিম্নমান, অতিরিক্ত ভিড় এবং পরিবেশ এত অস্বাস্থ্যকর, যে রোগীরা সেখানে যেতে দুইবার চিন্তা করেন।
এসব সমস্যার জন্য সবচেয়ে বেশি অনিয়মে অভিযুক্ত হাসপাতালের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ডিএমসিএইচ)।
মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণী তাহসিন ফারজানা বলেন, ‘বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে যাওয়ার কথা আমি কখনোই ভাবি না, ঢাকা মেডিকেল কলেজ তো দূরের কথা।’
তাহসিনের মতে, হাসপাতালগুলোতে রোগীদের স্বস্তিতে রাখা উচিত, তবে বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা অত্যন্ত হতাশাজনক।
এসব হাসপাতালের শৌচাগারগুলো সবচেয়ে নোংরা স্থান উল্লেখ করে তিনি বলেন, রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনরাও কিছুক্ষণ পরেই অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন।
তাহসিন বলেন, ‘এই অবস্থা আর সহ্য করা যায় না। হাসপাতাল এমন একটি স্থান হওয়া উচিত যেখানে রোগী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে এটি আশা করা যেন একটি স্বপ্ন মাত্র।’
আরও পড়ুন: ওষুধ ঘাটতি-সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ঢামেক হাসপাতালে
পরিচ্ছন্নতার মারাত্মক অভাব
হাসপাতালের ওয়ার্ড বা অপারেশন থিয়েটারই শুধু নয়, অপেক্ষমান কক্ষ, টয়লেট ও ক্যাফেটেরিয়ার মতো অন্য লোকজনের চলাচলের জায়গাগুলোও পরিচ্ছন্ন রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতার অভাবে স্বাস্থ্যসেবা-সম্পর্কিত সংক্রমণ (এইচএআই), এমআরএসএ’র মতো ওষুধ-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বাড়াতে ভূমিকা রাখে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
সাদারণ জীবানুনাশকের সঙ্গে হাইপোক্লোরাইট জীবাণুনাশক নিয়মিত ব্যবহার করলে সি. ডিফিসিল সংক্রমণ কমানো যায়। এটি কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।
তবে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে পরিচ্ছন্নতার বিষয় আশঙ্কাজনকভাবে নিম্নমানের।
ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফের সাম্প্রতিক জেএমপি রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের মাত্র ৩৮ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি সেবা রয়েছে। এছাড়া সরকারি হাসপাতালে (৩২ শতাংশ ) ও বেসরকারি হাসপাতালে (৬৯ শতাংশ) এর পার্থক্য লক্ষণীয়।
আইসিডিডিআরবির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি হাসপাতালের মাত্র ৩৩ শতাংশ শৌচাগার পরিষ্কার। এছাড়া অধিকাংশ শৌচাগারে মাসিক-সংক্রান্ত স্বাস্থ্য সামগ্রী ফেলার ব্যবস্থা এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য সুবিধা নেই।
ঢাকার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ২,৪৫৯টি শৌচাগার নিয়ে করা এই গবেষণায় দেখা গেছে, এখানে ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুযায়ী শৌচাগারের সংখ্যা অপ্রতুল। যেখানে জাতীয় মান অনুযায়ী ১:৬, সেখানে সরকারি হাসপাতালে এই অনুপাত পৌঁছেছে ২১৪:১।
আরও পড়ুন: অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত ঢামেক হাসপাতাল
অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত ঢামেক
দেশের অন্যতম প্রধান সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাপক চাপে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
ঢামেকে রোগীর সংখ্যা হাসপাতালের নির্ধারিত ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ কারণে সেবার গুণমান মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। আসন সংকট ও পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাবে ওয়ার্ড থেকে শুরু করে করিডোর পর্যন্ত মেঝেতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান খান এসব সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে বলেন, অতিরিক্ত ভিড় ও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবের কারণে চিকিৎসা সেবার অবনতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘একটি শৌচাগার ব্যবহার করতে হয় ১০ জন রোগীকে। ২,৬০০ জনের জন্য তৈরি স্থাপনায় ৪,৩০০ রোগী থাকে। সেই সঙ্গে প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে দুই-তিনজন সহকারীও থাকে। এর ফলে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা কম থাকে।’
তিনি ব্যবহারকারীদের আচরণ সম্পর্কেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘আমরা পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করি, কিন্তু অনেক রোগী ও তাদের স্বজনরা স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন নন। টয়লেটে স্যানিটারি প্যাড ও প্লাস্টিক ব্যাগের মতো আবর্জনা ফেলেন। এসব কারণে সমস্যা আরও বেড়ে যায়।’
কর্মী সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশেষত চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের অভাব, হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বাধা সৃষ্টি করছে।
ঢাকার প্রধান হাসপাতালগুলোর স্যানিটেশন নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনি, বাংলাদেশের আইসিডিডিআরবি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের গবেষকরা।
গবেষণায় বিশেষত বহির্বিভাগের সেবায় টয়লেটের কার্যকারিতা, পরিচ্ছন্নতা ও প্রবেশাধিকার নিয়ে গুরুতর সমস্যাগুলো উঠে এসেছে। সেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে স্যানিটেশন মান নিশ্চিত করতে উন্নত সম্পদ ও ব্যবস্থাপনার সুপারিশ করা হয়েছে। ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চালানো এই ক্রস-সেকশনাল গবেষণায় ১০টি সরকারি এবং দুটি বেসরকারি হাসপাতালের টয়লেটের কার্যকারিতা, পরিচ্ছন্নতা এবং ব্যবহারকারী ও টয়লেটের অনুপাত মূল্যায়ন করা হয়।
ফলাফল থেকে জানা যায়, সরকারি হাসপাতালের মাত্র ৬৮ শতাংশ এবং বেসরকারি হাসপাতালের ৯২ শতাংশ টয়লেট কার্যকর ছিল। পরিচ্ছন্নতার অবস্থা আরও উদ্বেগজনক, যেখানে সরকারি হাসপাতালের মাত্র ৩৩ শতাংশ এবং বেসরকারি হাসপাতালের ৫৬ শতাংশ টয়লেট পরিচ্ছন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, বিশেষত বহির্বিভাগ সেবায় ব্যবহারকারী ও টয়লেটের অনুপাত খুবই অপ্রতুল। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এ অনুপাত ছিল ২১৪:১ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছিল ৯৪:১।
বিশ্বাসযোগ্যভাবে, মাত্র ৩ শতাংশ টয়লেটের মধ্যে স্যানিটারি প্যাড ফেলার জন্য ডাস্টবিন ছিল এবং ১ শতাংশ এরও কম টয়লেট প্রতিবন্ধী ব্যবহারকারীদের জন্য উপযুক্ত ছিল।
ঢাকা শহরের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে স্যানিটেশন সুবিধা উন্নত করা ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) পূরণের জন্য অত্যন্ত জরুরি বলে জোর দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা এসব সমস্যার সমাধানে হাসপাতাল প্রশাসকদের নেতৃত্ব, আরও সম্পদ এবং রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
এই গবেষণায় স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রের মৌলিক স্যানিটেশন এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত নীতিগত হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
জরুরি সংস্কারের আহ্বান
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিস্থিতি দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার একটি বৃহত্তর সংকটের প্রতিফলন। ঢামেকের নিম্নমানের স্বাস্থ্যবিধি, কর্মী সংকট, বাজেটের অভাব এবং অপর্যাপ্ত সুবিধা জনসাধারণের জন্য উপলব্ধ স্বাস্থ্যসেবার এক করুণ চিত্র উপস্থাপন করে।
এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদ বরাদ্দ, নিবেদিত রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী এবং বিশেষভাবে, পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধি ও রোগী সেবার মান বজায় রাখতে শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন। রোগীর সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি অবনতির দিকে চলে যাচ্ছে। অথচ সংস্কারের বিষয়ে কখনো জোর দেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন: ঢামেক ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বহির্বিভাগ পুরোদমে চালু