শ্রমিক সংকটের কারণে যশোরের মনিরামপুরের তাঁত শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। কাপড় বুননের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, প্রশিক্ষণের অভাবসহ আধুনিক প্রযুক্তির কাছে মার খাচ্ছে এ পেশার লোকজন। যে কারণে মনিরামপুরের তাঁতি সম্প্রদায়ের লোকেরা এখন ভিন্ন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
মনিরামপুর উপজেলার ২৪৯ গ্রামের মধ্যে ৭৮ গ্রামে প্রায় ৮০ হাজার তাঁতির বসবাস। এর মধ্যে ভরতপুর, পাড়ালা, মুজগুন্নীতে উল্লেখযোগ্য।
আরও পড়ুন: রাজগঞ্জের নারীদের তৈরি হস্তশিল্প যাচ্ছে ইউরোপে
সরেজমিনে দেখা গেছে, এক সময় উপজেরার পাড়ালা গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙতো তাঁত বুননের প্রাচীন যন্ত্র পিতলুম ও ঠকঠকানির শব্দে। বর্তমানে সেই পাড়ায় এখন তাঁতি সম্প্রদায়ের বাড়িতে পিতলুম ও ঠকঠকিগুলো গুটিয়ে রেখেছেন। এ গ্রামের আব্দুর রউফ একসময় বড় তাঁত শিল্প পরিচালনা করতেন। সে সময় তার বাড়িতে ৬০ থেকে ৭০ পিতলুম ও ঠকঠকি যন্ত্র ছিল। বর্তমানে তার বাড়িতে ২২ পিতলুম দিয়ে কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। আব্দুর রউফের পাশের বাড়ি আব্দুল্লাহর। তিনিও নির্ভিরশীল এ পেশার থেকে উপার্জনের প্রতি। বর্তমানে তিনিও ছেড়ে দিতে বসেছেন এ শিল্প।
পাড়ালা গ্রামের তাঁতি আব্দুর রউফ, আব্দুল্লাহ, নেহালপুরের মোক্তার হোসেন ও লাল মিয়া জানান, এ পেশায় এখন আর তাঁতিদের পেটে ভাত হয় না। সেই পুরনো আমলের কাপড় বুননের যন্ত্র দিয়ে কাপড় তৈরির কাজে শ্রমিকদের অনেক সংকট রয়েছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন শ্রমিক দুই গজ গামছা বুনলে মুজুরি পাবেন ৪০ টাকা। এ মূল্যে সারদিন কাজ করলে শ্রমিকের মূল্য হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। তা দিয়ে বর্তমানে কোন পরিবারের সংসার চলতে পারে না। যে কারণে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে পেটের দায়ে ভিন্ন পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে এক বিদ্যালয়ে ৮৫ শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে!
এছাড়া একখানা গামছা বুনন ও বিক্রিতে মালিক পান মাত্র দুই টাকা। যে কারণে এ পেশা থেকে সরে যাচ্ছেন তারা।
এ অঞ্চলের তাঁতিদের দাবি, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনার তাঁতিদের সাথে টিকে থাকা আদৌ সম্ভব না। তারা বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পেশাকে এগিয়ে নিয়েছেন। এ কারণে মনিরামপুর নয় বৃহত্তম যশোর জেলা তাঁতিদের অবস্থান এখন অনেক খারাপ।
তারা জানান, এ পেশা টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারের সহযোহিতা। তাছাড়াও এ পেশার লোকদের প্রয়োজন সহজ শর্তে স্বল্পসুদে ঋণ দেয়া। বর্তমান সরকার এ অঞ্চলের তাঁতি সম্প্রদায়ের প্রতি সুদৃষ্টি দিলে পূর্ব পুরুষের এ পেশা টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।
একই দাবি মুজগুন্নী গ্রামের তাঁতি রফিকুল ইসলাম, শ্যামনগর গ্রামের মোন্তাজ আলীসহ আরো অনেকেই।
আরও পড়ুন: সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন: কাঁটাতারে বাঁধা শিক্ষক-শিক্ষার্থী!
উপজেলা তাঁতি লীগের সভাপতি মনিরুজ্জামান জানান, তাঁতি সম্প্রদায়কে অতীত পেশায় টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সরকারের সহযোগিতা। তা না হলে অচিরেই মনিরামপুর থেকে বিলুপ্ত হবে তাঁত শিল্প।
বাংলাদেশ তাঁতি লীগের কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মাদ বাবুল আকতার জানান, তাঁতি সম্প্রদায় ও তাঁত শিল্পকে মনিরামপুরে টিকিয়ে রাখতে হলে এ মুহূর্তে প্রয়োজন এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের আধুনিক প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং তাঁতি সম্প্রদায়কে সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে সহযোগিতা করা। এক্ষেত্রে সরকার আন্তরিক হলে তাঁতি সম্প্রদায়ের লোকেরা অতীত পেশা নিয়ে টিকে থাকতে পারবে বলেও তিনি মনে করেন।