সত্যিকার সাংবাদিক যারা, তাদেরকেও ‘সত্য’ নামক ‘কঠিন’কে ভালোবেসে সামনের দিকে এগুতে হয়। দিন নেই, রাত নেই, সারাক্ষণ তাদেরকে লেগে থাকতে হয় তথ্য সংগ্রহের পেছনে। কথাগুলো মনে পড়ে গেলো ‘সাংবাদিকতা রাত বিরাতে’ বইটি পড়ে। বইটি যিনি লিখেছেন, তিনি দীর্ঘদিন থেকে সাংবাদিকতার সাথে সম্পৃক্ত। আমাদের দেশে অনেক সাংবাদিক আছেন, যাদের পঠিত বিষয় ও পেশার মধ্যে পার্থক্য মেরু দূর। ফলে পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে তারা পদে পদে নানান সমস্যার সম্মুখীন হন এবং কখনো কখনো পিছিয়ে পড়েন। বইটির লেখক মাহফুজুর রহমানের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। ফলে তাঁর পঠিত বিষয় ও পেশা কখনো পরস্পরের প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেনি, বরং এমন এক প্রীতিময় পরম্পরা সৃষ্টি করেছে, যাকে এককথায় বলা যায় সোনায় সোহাগা। 'লেখকের কথা'য় তিনি নিজেই লিখেছেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে এ পেশায় সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পেলাম। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটি একটি বড় সুযোগ। কারণ এ দেশে ছাত্রছাত্রীরা অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠিত বিষয়ের সাথে মিল রেখে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারে না। আমার ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি এই যে, আমি এ দুটোর মধ্যে মিল রাখতে পেরেছি।”
সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটাকে কেউ কেউ দায়বদ্ধতাও বলেন। এই দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে দারুণভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বইটির লেখক মাহফুজুর রহমান। তিনি লিখেছেন, “একটি সংবাদ প্রতিবেদনে একজন সাংবাদিক কখনোই নিজের কথা বলেন না। সাংবাদিকরা তাদের লেখায় আসলে অন্যের কথা যেভাবে বলা হয়েছে ঠিক সেভাবে তুলে ধরেন। কোনো ঘটনা যেভাবে ঘটেছে ঠিক সেভাবে তুলে ধরাই হচ্ছে তার দায়িত্ব।... সাংবাদিক কোন ঘটনার অংশ নন।” (পৃ-৫৪)। এই যে বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা কিংবা দায়বদ্ধতা- এসব একটি অন্যটির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। একটিকে বাদ দিলে অন্যটি পঙ্গু বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এগুলোর সঠিক কার্যকারিতা নির্ভর করে সাংবাদিকের অর্জিত বাস্তব ও বুদ্ধিদীপ্ত অভিজ্ঞতা এবং সততার ওপর, যে সততাকে সাংবাদিক-সততাও বলা যেতে পারে।
আমরা জানি রাজনীতিতে আবেগ চলে অশ্ব গতিতে। এই আবেগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিবেককে বিনষ্ট করে দেয়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এই আবেগ অনাকাঙ্ক্ষিত ও অশনিসংকেত। তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অন্যত্র তিনি লিখেছেন, “রাজনীতিতে এখন যুক্ত হয়েছে সত্য-পরবর্তী বাস্তবতার কথা। সত্য-পরবর্তী বাস্তবতায় যে আলোচনাটি নিয়ে আসা হচ্ছে সেটি হচ্ছে রাজনীতিতে যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রাধান্য। এই আবেগ যুক্তি ও তথ্যকে উপেক্ষা করছে। যুক্তি এবং তথ্যের জায়গাটি দখল করে নিচ্ছে আবেগ।... এই আবেগের চাপে শেষ পর্যন্ত প্রকৃত সত্যটাই হারিয়ে যাচ্ছে।” (পৃ-১৭)। রাজনৈতিক সাংবাদিকতায় আবেগের অনিষ্টতা তো আছেই, আরো আছে গল্প তৈরির অবাস্তবতা। কিন্তু এই অবাস্তবতার স্থান নেই সত্যিকার সাংবাদিকতায়। বরং সংঘাতের সম্পর্ক সব সময়। কেননা বাস্তবতার সাথে সাংবাদিকতার সংযোগ, অবাস্তবতা হলো একটি রোগ। তারপরও মানুষ আবেগ তথা গল্পের ফাঁদে পড়ে সত্য থেকে বঞ্চিত হয়। সেকথা খুব সুন্দর ও সুনিপুণ ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন বইটির বিজ্ঞ লেখক মাহফুজুর রহমান। তিনি লিখেছেন, “সাংবাদিকেরা এখন গল্প তৈরি করার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এ কাজ বেশি চলছে রাজনৈতিক সাংবাদিকতায়। কারো কোনো ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারি হলে তো কথায় নেই! বিশেষ করে নারীর ক্ষেত্রে। এ জাতীয় বিষয়ে এমন সব গল্প লেখা হয়, মনে হয়ে যেন ঘটনা ঘটার সময় সাংবাদিক আশেপাশে কোথাও ছিলেন। সচেতন পাঠক বুঝতে পারেন, এটি একটি বানানো গল্প। তারপরও তারা সেসব পড়েন। কারণ তাদেরও ভালো লাগে। বেশ রসিয়ে লেখা হয় এসব গল্প।” (পৃ-৫২)।
তিনি লিখেন, “দেখলাম, এক ভদ্রলোক তিন-চারটা পত্রিকা ভাঁজ করে হাতে নিলেন। আমার চোখাচোখি হতেই ভদ্রলোক একটু হাসলেন। কিছু জিজ্ঞেস না করতেই বললেন, ‘ট্রেনে বসে বসে পড়ব। একেক পত্রিকা একেক রকম লেখে তো তাই বোঝা মুশকিল কোনটি বিশ্বাসযোগ্য।’ একজন পাঠকের এ আচরণ আমাদের বর্তমান সাংবাদিকতার ওপর তাদের অনাস্থার প্রকাশ।” (পৃ-১৫)।
যে কোনো সংবাদ সৃষ্টিতে সহজতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ সে ক্ষেত্রে পণ্ডিতির প্রয়োজন যেমন নেই, পাঠকরাও পছন্দ করেন না। সে জন্য সংবাদ লিখতে হয় সহজ ভাষায়, সংক্ষেপে; যাতে সর্বসাধারণ তা সহজে বুঝতে পারে। কিন্তু এই সহজ করে লেখাটা যে সহজ নয়- কঠিন। তাই তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘সহজ কথা লিখতে আমায় কহ যে / সহজ করে যায়না লেখা সহজে।’ মাহফুজুর রহমান বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, “সাংবাদিকতার গদ্য অন্য যে কোনো গদ্যের চেয়ে আলাদা। সাংবাদিকতায় বক্তব্য প্রকাশ করতে হয় সহজ-সরলভাবে। যাতে পাঠক কোথাও হোঁচট না খায়। একটা প্রতিবেদনের ভাষা হবে এতটা প্রাঞ্জল যে তথ্য-বক্তব্য ঝর্ণার পানির মতো উছলে উঠবে। সহজ করে বলার কৌশল অর্জন অনেক কঠিন কাজ।” (পৃ-১১৯)। এই কঠিন কাজ করায়ত্ত করতে হলে কী করতে হবে সেকথাও বলতে বাদ রাখেননি। তিনি লিখেছেন, “এজন্য সচেতন গদ্য চর্চার প্রয়োজন হয়। সহজ-সরল গদ্যশৈলী অর্জন তখনই সম্ভব, যখন ভাষায় সাথে একটা ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হবে। উপন্যাস পড়তে পড়তে অনেকে ভালো বাংলা গদ্য আয়ত্তে নিয়ে আসেন। অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই- বিশেষ করে শক্তিশালী লেখকের বই।” (পৃ-১১৯)। তিনি ঠিকই বলেছেন- ভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। সত্যিই তো, কোনো কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে, কাজটিকে আনন্দের অভিজ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করতে পারলে, কাজটি যত কঠিনই হোক না কেন, কঠিন থাকেনা, সহজ হয়ে যায়।
এরপর আর কী কী যোগ্যতা বা গুণ থাকা প্রয়োজন তাও বইটির বিভিন্ন জায়গায় ব্যক্ত করেছেন তিনি। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “তারপর দরকার এ দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে পর্যাপ্ত জ্ঞান। যিনি এ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতি যত ভালো বুঝবেন তিনি তত ভালো সাংবাদিক হতে পারবেন।... ভালো লেখার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।” (২৩-২৪)। সাংবাদিক মাহফুজুর রহমানের গদ্যই তার উজ্জ্বল উদাহরণ। গদাই লস্করি গদ্যের বিপরীতে গতিময় তার গদ্য- ঝর্ণা ধারার মতো উচ্ছল, উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত এবং স্মার্টও। এই অর্জনটা তাঁর দীর্ঘদিনের অধ্যাবসায়, অভিজ্ঞতা ও চর্চার ফল। এক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে তাঁর সাহিত্যানুরাগ। ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু জানি, যখন তিনি গ্রামের গণ্ডিতে ছিলেন, সেই পাঠ্যজীবনে পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও তাঁর প্রীতি ছিলো সাহিত্যের প্রতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে গিয়ে তা ব্যাপ্তি লাভ করে। পাঠ্যবহির্ভূত বই, বিশেষ করে সাহিত্য বিষয়ক বই-পুস্তক পড়া ও লেখা চালিয়ে যেতেন সমান তালে। অনুবাদ করতেন, ফিচার লিখতেন ‘ঢাকা ডাইজেস্ট’সহ বিভিন্ন কাগজে।
পরবর্তী পর্যায়ে তিনি ‘ঢাকা কুরিয়ার’সহ নানান জায়গায় ফিচার লিখেছেন। তাঁর মতে, ‘ফিচারে ভাষাগত বৈচিত্র বেশি।’ একদিকে সহজ-সরল ভাষার গতিময় গদ্য, অন্যদিকে ভাষাগত বৈচিত্র্য, তার সাথে দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলো- সবকিছুর স্মারক সাংবাদিকতা সম্পর্কিত তাঁর বইটি। প্রাসঙ্গিকভাবে বলা প্রয়োজন, দীর্ঘ পেশাজীবনে তিনি প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেছেন বটে, কিন্তু পেশা পরিবর্তন করেননি। এতে তাঁর যেমন লাভ হয়েছে, তেমনি আমাদেরও। তাঁর লাভ হয়েছে অনেক অভিজ্ঞতা, আর আমাদের লাভ হলো সেই অভিজ্ঞার আলোয় অবগাহন করা। তাঁর পেশা জীবনে প্রবেশ বার্তা সংস্থা ইউএনবি-তে যোগদানের মাধ্যমে। মাঝে ২০১০ সালে ইউএনবি ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সান-এর বার্তা সম্পাদক হিসেবে। এবং এরপর অনলাইন গণমাধ্যম বিডিনিউজ২৪.কম-এ। সেখান থেকে ইউএনবি-তে প্রত্যাবর্তন।
তাই বইটি অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা, সেটা না বললেও বোঝা যায়। সূচিপত্রের দিকে চোখ বোলালেও বোঝা যায়, মূল বিষয়কে কেন্দ্রে রেখে তার বিভিন্ন দিক নিয়ে নিজের বীক্ষাকে কত বিজ্ঞতার সাথে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। বইটি প্রকাশ পেয়েছে রিদম প্রকাশনা, ঢাকা থেকে মে ২০১৯ সালে। মূল্য রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা। আমার মনে হয়েছে, বইটিকে মুদ্রিত মূল্যের মাধ্যমে তার মান বিচার করা যাবেনা, এটি এর ভেতরের মনিমুক্তসম লেখাগুলো নিয়েই বেশি মূল্যবান। সাংবাদিকতার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট, কিংবা অত্র পেশায় আসতে আগ্রহী, তাদের জন্য তো বটেই; যারা এ বিষয়ে গবেষক, তাদের জন্যও গ্রন্থটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমি বইটির বহুল প্রচার ও ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা প্রত্যাশা করি।