রাজপথে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া শুধু আইনি প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে শিগগিরই খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করার কোনো আশা দেখছেন না বিএনপির সিনিয়র নেতা ও খালেদার আইনজীবীরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি এবং এর নেতা-কর্মীদের পুনরুজ্জীবিত করতে খালেদা জিয়াকে মুক্তির একক ইস্যুতে আন্দোলনের দিকে দলটির মনোনিবেশ করা উচিত।
খালেদার কারাবাসের এক বছর উপলক্ষে শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে বিএনপি একটি প্রতিবাদ সমাবেশ করবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, শুক্রবার দুপুর ২ টা ৩০ মিনিটের দিকে অনুষ্ঠানটি শুরু হবে।
এছাড়া শনিবার সারাদেশে দলের বিভিন্ন ইউনিটও একইরকম প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করবে।
শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির একটি সমাবেশ আয়োজন করার পরিকল্পনা ছিল, তবে একই ভেন্যুতে চলমান একুশে বইমেলার কারণে সমাবেশটি পরে স্থগিত করা হয়।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় নিম্ন আদালত খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। রায় ঘোষণা দিনই বিএনপি প্রধানকে পুরানো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
গত ৩০ অক্টোবর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালতের ৫ বছরের সাজা দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১০ বছর করার আদেশ দেন হাইকোর্ট।
গত ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত।
বিএনপি নেত্রীর বিরুদ্ধে বর্তমানে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল দুর্নীতি মামলাসহ প্রায় ৩৬টি মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
দলের চেয়ারপার্সন কারাগারে বন্দী হওয়ার পর বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালায় এবং গত দুই মাস ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। তবে তাতে তেমন কোনো ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে বিএনপি বিভিন্ন সিটি নির্বাচনে যোগ দেয়। এছাড়া আদালতের ওপর খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি ছেড়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-১, বগুড়া-৬ ও বগুড়া-৭ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য বিএনপি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু তার সকল মনোনয়নপত্র বাতিল করে খালেদাকে নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করেন আদালত ও নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
খালেদাকে কারাগারে রেখেই বিএনপি নির্বাচনে যোগ দেয় এবং বিপুলভাবে পরাজিত হয়। দলটি নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসন লাভ করে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা জানান, কারাগার থেকে বের হওয়ার জন্য বিএনপি প্রধানকে এখন চারটি মামলায় জামিন পেতে হবে। তবে তার মুক্তির বিষয়টি সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদার উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে সাধারণ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্ত করা খুব কঠিন হবে কারণ সরকার বিচার বিভাগসহ সকল প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে ফেলেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি না যে, আমরা আইন ওপর নির্ভর করে তাকে কারাগার থেকে মুক্তি করবে পারব।’
তিনি বলেন, ‘খালেদাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে রাজপথ গরম করা। তা না করা পর্যন্ত আমরা খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করবে পারব না।’
এদিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ নেতারা জানান, তাদের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দীর্ঘদিন ধরে তাদের সিনিয়র নেতারা ঐক্যবদ্ধ থাকলেও নেতৃত্ব ও দলীয় সংস্কারের বিষয়ে এখন তাদের মধ্যে বিভেদ রয়েছে।
দলীয় নেতাদের মধ্যে বিভাজন সম্পর্কে তারা বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পরে তারা তৃণমূল পর্যায়ের কার্যকর আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য কোন কর্মসূচি নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ইমাজউদ্দীন আহমেদ ইউএনবিকে বলেন, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপির সিনিয়র নেতারা দলের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।
তিনি বলেন, বিএনপি ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ জাতীয় নির্বাচনের বিরুদ্ধে তেমন প্রতিবাদ করতে পারেনি এবং দলের তৃণমূল পর্যায়কে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কোনো কার্যকর কর্মসূচি নিয়ে আসতেও পারেনি।
ইমাজউদ্দীন বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও রাজনীতিতে ফিরে আসার জন্য বিএনপিকে আইনি যুদ্ধ এবং আন্দোলন উভয়ই চালিয়ে যেতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর পর তাদের দলের তিনটি চ্যালেঞ্জ ছিল- নেত্রীর মুক্তি, জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ ও দল শক্তিশালীকরণ। কিন্তু আমরা সফলভাবে কোনও চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে পারিনি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘শুধুমাত্র বিএনপিকে সংকটের মধ্যে রাখার জন্য সরকার এক বছর ধরে খালেদা জিয়াকে কারাবন্দী রেখেছে। আমরা একটি আইনি যুদ্ধে মাধ্যমে তার মুক্তির জন্য চেষ্টা করছি। আমরা তাকে মুক্ত করার জন্য কার্যকর কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করবো।’
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দীন সরকার বলেন, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে তার সন্দেহ রয়েছে। ‘আমি মনে করি, আমরা যদি রাস্তায় নেমে কঠোর আন্দোলন করতে না পারি, তাহলে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মওদুদ আহমেদ বলেন, সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া আদালতে কিংবা আইনজীবীরাও খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারবেন না।
‘সরকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করে দিলে খালেদা জিয়া সাত দিনের মধ্যে মুক্ত হতে পারবেন। এজন্য এখন তাকে মুক্ত করতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য আমাদের অবশ্যই একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা উচিত,’ বলেন তিনি।