বিশেষ সংবাদ
বন্যায় বারবার ভেসে যায় স্বপ্ন, টেকসই বাঁধ চায় ফেনীবাসী
বর্ষা শুরু হতে না হতেই বন্যার আশঙ্কা উদয় হয় ফেনীবাসীর মনে। বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ এই জেলায় যেন এক পরিচিত পুনরাবৃত্তি, বছর বছর ফিরে আসে একই দুর্যোগ, আর থেকে যায় দগদগে ক্ষত। প্রশ্ন ওঠে, টেকসই বাঁধ নির্মাণ কি হবে না? ফেনীবাসী কি রক্ষা পাবে না বন্যার ভয়াবহ থাবা থেকে?
শনিবার (১২ জুলাই) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ফেনীর বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে যান। সে সময় স্থানীয়রা টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য তার কাছে দাবি জানান। জবাবে ফেনীতে বাঁধ নির্মাণের জন্য ৭ হাজার ৩৪০ কোটির প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
সম্প্রতি ভারতের উজান থেকে নেমে আসা বাঁধভাঙা পানি পরশুরাম ও ফুলগাজী থেকে গড়িয়ে ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে পড়ে। শুক্রবার পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২৩টি স্থানে ভেঙে ১১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত গ্রামগুলোর অন্তত ৩৪ হাজার ৬০০ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফলে সীমান্তবর্তী ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদরের আংশিক নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। বিভিন্ন সড়ক পানিতে তলিয়ে গিয়ে বন্ধ রয়েছে যান চলাচল। বন্যার্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ ও নেটওয়ার্ক না থাকায় মানুষের বিপদ আরও বেড়েছে।
এখন ধীরে ধীরে বন্যার পানি নেমে যাচ্ছে, আর ভেসে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। পরশুরামে অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি পানিতে ধসে পড়েছে। ফুলগাজীতে পানিতে ডুবে পচে গেছে রোপা আমন ধান। আবার কারো ধান বালুর স্তুপে ঢেকে গেছে। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন হাজারো কৃষক।
আক্ষেপ করে ফুলগাজীর উত্তর শ্রীপুর এলাকার বৃদ্ধা রেজিয়া বেগম জানান, বছর না ঘুরতেই আবারও পানিতে ডুবতে হয়েছে। সব জিনিসপত্র ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এ অঞ্চলে জুলাই-আগস্ট মাসে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সবমিলিয়ে মাঝেমধ্যে মনে হয়, এখানে জন্মগ্রহণ করে ভুল করেছি।
শুধু রেজিয়াই নন, বারবার একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে এমন দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে জেলার উত্তরের ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলার লাখো মানুষকে। এবারও তিন দিনের ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজানের পানিতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২৩টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন: ফেনীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৭ স্থানে ভাঙন, ৩৫ গ্রাম প্লাবিত
ফুলগাজীর উত্তর শ্রীপুর এলাকার বাসিন্দা আলী আজ্জম বলেন, বাঁধের ভাঙন স্থানে তীব্র স্রোতে পানি ঢুকছে। সময়ের সঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গত বছরের বন্যার মতো এবারও বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যা নিয়ে ভুগতে হচ্ছে। রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতা পরিবর্তন হলেও আমাদের ভাগ্য কখনো পরিবর্তন হয় না।
গাইনবাড়ি এলাকার বাসিন্দা পুষ্পিতা রাণী বলেন, ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। পরিবারের শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট করতে হচ্ছে। শুকনো খাবার ও নিরাপদ পানির সংকটে আরও বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার দায়সারা কাজের জন্য প্রতি বছর এ জনপদে ভাঙন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এখন টেকসই বাঁধই আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য একমাত্র সমাধান।
১৫৫ দিন আগে
ধরলার ভাঙনে নিঃস্ব অর্ধশতাধিক, ঝুঁকিতে আরও পাঁচ শতাধিক পরিবার
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার চরগোরকমন্ডল এলাকায় ধরলার তীব্র ভাঙনে অর্ধশতাধিক পরিবারের ঘরবাড়িসহ শত শত বিঘার ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতে অনেকেই আগে থেকে ঘরবাড়ি অন্য এলাকায় সরিয়ে নিচ্ছেন।
এ ছাড়া বাড়িঘর, ভিটামাটিসহ শত শত বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় চরম দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন আরও পাঁচ শতাধিক পরিবার। ধরলার ভাঙন রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে টেকসই তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শেষ সম্বল ঘরবাড়ি ও ভিটেমাটিটুকু নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় চরম দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন চরগোরকমন্ডল গ্রামের বাসিন্দা আলা-বকস (৬৫)। ভাঙতে ভাঙতে ধরলা নদী তার বাড়ির কাছে এসে পড়েছে। আগ্রাসী ধরলার কবল থেকে ঘরবাড়ি রক্ষা করতে ইতোমধ্যে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছের তিনি। কিন্তু নতুন জায়গায় নতুন করে ঘর তুলতে গেলেও তো টাকা লাগে। তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটছে এই বৃদ্ধের।
আলা-বসক বলেন, ‘কী কই বাহে! ৬৫ বছর বয়সে কমপক্ষে পাঁচবার বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বাড়িঘর, জমিজমা হারিয়ে পথে বসেছি। আমার নিজস্ব জমি না থাকায় গত চার বছর ধরে মানুষের জমিতে ঘরবাড়ি করে স্ত্রীসহ অতিকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। কিন্তু ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাস! ধরলার তীব্র ভাঙন আবারও বাড়ির কাছেই চলে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন আমার শ্যালকের জমিতে বসবাস করার জন্য ঘরবাড়ি সরানোর কাজ শুরু করেছি। কিন্তু টাকার অভাবে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।’
আরও পড়ুন: ফেনীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৭ স্থানে ভাঙন, ৩৫ গ্রাম প্লাবিত
একই এলাকায় জহুরুল ইসলাম (৩৫) ও তার স্ত্রী মাহমুদা বেগম বলেন, নদী ভাঙতে ভাঙতে একেবারে আমাদের বাড়ির পাশে চলে এসেছে। বাড়ি থেকে এখন নদীর দূরত্ব ২০ গজ। যেকোনো মুহূর্তে আমাদের বাড়িঘর সব নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
তারা আরও জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যে ধরলার ভাঙন ঠেকাতে না পারলে অনেক পরিবার পথে বসে যাবে।
১৫৬ দিন আগে
চট্টগ্রামে ব্যর্থতার মূল্য: মেগা প্রকল্পের পরও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ
চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএ, চসিক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের চারটি প্রকল্পের কাজ ২০১৭ সালে শুরু হয়ে ২০২২ সালে সব প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো পর্যন্ত এই চার প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৬০-৮০ শতাংশ। এত কিছুর পরেও মানুষের অসচেতনতা এবং পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনার অভাবে জলাবদ্ধতার এই দুর্গতি থেকে স্থায়ী রেহাই মিলছে না।
গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে নগরীর নিচু এলাকায়। জলাবদ্ধতা মুক্তির প্রকল্পে খাল সংস্কার হওয়ায় বেশ কিছু এলাকায় পানি দ্রুত নেমে গেছে। তবুও বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধ হয়ে পড়ছে নগরীর চকবাজার, মেহেদীবাগ, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, শুলকবহর ও আগ্রাবাদ।
এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। এদিকে গত কয়েক দিনের বৃষ্টির কারণে নগরীর পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় ধসের সতর্কতা দেওয়া হলেও কাউকে সরতে দেখা যাচ্ছে না। টানা বৃষ্টিতে নগরীর মেহেদীবাগ, চকবাজার, বাকলিয়া, আগ্রাবাদ, হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা।
এদিকে টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের শঙ্কা তৈরি হওয়ায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ আবাস থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ থাকলেও সেখান থেকে কাউকে নিরাপদ এলাকায় যেতে দেখা যায়নি।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, নগরীর ৩৬টি খাল খননের মধ্যে ২১ খালের কাজ হয়েছে। এছাড়া ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর ও পাম্প হাউসের জায়গায় চারটি খালের মুখে কাজ শেষ হয়েছে।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সাথে যুক্ত কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শানস বলেন, প্রকল্প কাজ অব্যাহত থাকায় আগের চেয়ে নগরীর জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমেছে। তবে অপচনশীল বর্জ্যের কারণে পানি চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, নগরীতে চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোর মালিকানায় যেসব ব্যক্তি ও সেবা সংস্থা আছে, তাদেরকে জবাবদিহিতার জায়গায় আনা দরকার। না হলে পাহাড় ধসে মৃত্যুর শঙ্কা থাকবেই।
তবে নগরীর বাসিন্দারা জানান, মূলত নগরীর জলাবদ্ধতার দুর্ভোগের জন্য দায়ী মানুষের অসচেতনতা এবং পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনার অভাব। আগের তুলনায় জলাবদ্ধতা কমলেও দুর্ভোগ থেকে স্থায়ী রেহাই মিলছে না। এখনও ভরা বর্ষায় প্রতিনিয়ত জলাবদ্ধতার আতঙ্কে থাকে নগরবাসী। বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এই জনদুর্ভোগ। অথচ নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ১৪ অর্থবছরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তিন মেয়র প্রায় ৩২৪ কোটি টাকা খরচ করেছেন। এই টাকা ব্যয় হয়েছে নালা-নর্দমা ও খাল থেকে মাটি উত্তোলন, প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ, খালের তলা পাকাকরণ, খননযন্ত্র ও মাটি সরানোর কাজে ট্রাক কেনায়। জলাবদ্ধতা দূর করতে প্রতি বছর গড়ে খরচ হয়েছে ২৩ কোটি টাকা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীদের মতে, পরিকল্পিতভাবে ওই টাকা খরচ হয়নি। রুটিন কাজ করেই দায় সেরেছে সিটি কর্পোরেশন। জল দূর করার টাকা যেন জলেই গেছে। ফলে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। আবার সমস্যা যতটা ব্যাপক, সে অনুযায়ী ব্যয় হওয়া অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে বিগত বছর এপ্রিল মাসে প্রবল বৃষ্টিতে দুবার ডুবেছে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকা। এরপর গত জুন বৃষ্টিতে আবার ডুবে যায় নগরীর বড় একটি অংশ। সেদিন থেকে টানা চার দিন ডুবে ছিল নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক আগ্রাবাদ এক্সেস রোড।
পরবর্তীতে বৃষ্টিতে নগরীর প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যায়। ডুবে যায় আগ্রাবাদের একটি হাসপাতালসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকা। তখন আবারও প্রায় তিন দিন ডুবে ছিল আগ্রাবাদ এক্সেস রোড। এ সময় সড়কে নৌকাও চলতে দেখা যায়। সর্বশেষ গত কয়েক দিনের প্রবল বৃষ্টিতে আবারও তলিয়ে যায় নগরী। তবে পানি দ্রুত সরে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা স্থায়ী হয়নি। এতে কিছুটা স্বস্তিতে নগরের বাসিন্দারা।
সূত্র মতে, চট্টগ্রাম নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের ২২টিতেই বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে কম-বেশি জলাবদ্ধতা হয়। নগরীর ৬০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৩১ লাখ ২৩ হাজার ৬১৩ জন এসব ওয়ার্ডে বসবাস করছেন। সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হয় চান্দগাঁও, পূর্ব ষোলশহর, শুলকবহর, চকবাজার, পশ্চিম বাকলিয়া, পূর্ব বাকলিয়া, দক্ষিণ বাকলিয়া, উত্তর আগ্রাবাদ, দক্ষিণ আগ্রাবাদ, পাঠানটুলী, বকসিরহাট, গোসাইলডাঙা, উত্তর মধ্যম হালিশহর এলাকার মানুষদের। এই ১৩ ওয়ার্ডে মোট বাসিন্দা ১৮ লাখ ২৮৫ জন।
পড়ুন: ফেনীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৭ স্থানে ভাঙন, ৩৫ গ্রাম প্লাবিত
এ ছাড়া পাঁচলাইশ, মোহরা, পশ্চিম ষোলশহর, উত্তর কাট্টলী, রামপুর, উত্তর হালিশহর, পাথরঘাটা, দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ও দক্ষিণ হালিশহরের বাসিন্দাদেরও জলাবদ্ধতায় ভুগতে হচ্ছে। এ ৯টি ওয়ার্ডে বাস করেন ১৩ লাখ ২৩ হাজার ৩২৮ জন।
সিটি কর্পোরেশনের বাজেট বই ও বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালে ২০০৩-০৪ থেকে ২০০৮-০৯ অর্থবছর পর্যন্ত জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যয় হয় ৬৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। মহিউদ্দিন চৌধুরীকে পরাজিত করে ২০১০ সালের নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মনজুর আলম। তার মেয়াদে ব্যয় হয় ২০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। পরে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন দায়িত্ব নিয়ে দুই বছরে খরচ করেছেন ৫২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, জলাবদ্ধতা এটি সমাধানযোগ্য সমস্যা। কয়েকটি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিলে জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হতো। তবে এই সমস্যা নিরসনের জন্য বসে না থেকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েও সরকারি ও আধা সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয় না থাকার কারণে জলাবদ্ধতা নিরসনে সমাধান হয়নি বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
চট্টগ্রাম নগরীতে শাখা-প্রশাখা মিলিয়ে ১১৮টি খালের মোট দৈর্ঘ্য ১৮২ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। বর্তমানে পাকা ও কাঁচা নালা-নর্দমা আছে যথাক্রমে ৭১০ কিলোমিটার ও ৫৫ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বরাদ্দ পায়। কর্পোরেশনের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের হার ১৭ থেকে ৩৫ শতাংশে ওঠানামা করে। আর রাজনৈতিক বিবেচনায় কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়। খাল ও নালা-নর্দমা থেকে মাটি উত্তোলন করে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব নয়। এ সমস্যা দূর করতে সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্বে সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করার বিকল্প নেই। আর বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের সময় সিটি কর্পোরেশন নালা-নর্দমা ও প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণে ৮২ কোটি ৮২ লাখ ৯১ হাজার টাকা এবং নালা-নর্দমা ও খাল থেকে মাটি অপসারণে ২১ কোটি ৯৭ লাখ ২৭ হাজার টাকা খরচ হয়। যখন নাগরিক দুর্ভোগ চরমে ওঠে, তখন লোক দেখানোর জন্য সব মেয়রই খাল খননের পাশাপাশি যন্ত্রপাতি কেনেন। এত টাকা পরিকল্পিত উপায়ে খরচ করা হলে নগরবাসী সুফল পেত।
আরও পড়ুন: চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে মেলখুম ট্রেইল থেকে পড়ে দুই বন্ধুর মৃত্যু, আহত ৩
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান করতে ১৯৯৫ সালে প্রণীত চট্টগ্রাম ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
তাদের মতে, কেবল জোড়াতালির কাজ করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বৃষ্টি ও জোয়ারজনিত জলাবদ্ধতা কিংবা বন্যা—এসব দুর্ভোগ থেকে চট্টগ্রাম নগরবাসীকে মুক্তি দিতে ১৯৯৫ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘চিটাগাং স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ অ্যান্ড ফ্লাড কন্ট্রোল মাস্টারপ্ল্যান’। এটি ‘ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে কী করণীয়, এই মহাপরিকল্পনায় এর স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের।
জলাবদ্ধতার কারণ
পাহাড় কাটার কারণে এর মাটি ও বালু বৃষ্টির পানির সঙ্গে এসে নালা-নর্দমা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আবার যেসব নালা-নর্দমা আছে, সেগুলো মানুষ দখল করে স্থাপনা তৈরি করছে এবং সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। এতে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ কারণটি হচ্ছে, খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পানি যেখানে পড়বে (কর্ণফুলী নদীতে), সেখানে মুখগুলো উঁচু হয়ে গেছে। ফলে জোয়ারের সময় নদীর পানি সহজে প্রবেশ করছে, পরে আর বের হতে পারছে না।
দ্রুত জনসংখ্যা বাড়ছে, পরিকল্পিতভাবে নগরায়ণের কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। মানুষ যত্রতত্র বাড়ি তৈরি করছে। আগে যেখানে পানি জমত, সেগুলো ভরাট করছে। পাহাড় কেটে ফেলছে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত এই নগর।
নিচু এলাকা এবং জলাধার ও জলাশয় ভরাট করে ভবন তৈরি করা হচ্ছে। এতে ড্রেনেজ এলাকা কমে যাচ্ছে। আবার নালা-নর্দমা ও খালগুলো দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। অবৈধভাবে পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়ি বালু নালা ও খালে পড়ে তা ভরাট হয়ে গেছে। খালের ভিতর দিয়ে সেবা সংস্থার পাইপলাইন গিয়ে পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। নালা-নর্দমা ও খালকে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করার মানসিকতাও জলাবদ্ধতার সমস্যা প্রকট হওয়ার একটি কারণ। চট্টগ্রাম নগর সাগর ও নদীর পাশে গড়ে উঠেছে। ফলে জোয়ারের পানি অবাধে শহরে প্রবেশ করে লোকালয় তলিয়ে যায়। যখন একই সময়ে বৃষ্টিপাত ও উচ্চ জোয়ার থাকে, তখন অবস্থা ভয়াবহ হয়।
সম্ভাব্য সমাধান
শহরের জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানের জন্য পুনরায় যথেষ্ট পরিমাণ গবেষণা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
নিয়মিত ড্রেজিং করে কর্ণফুলীর গভীরতা বাড়াতে হবে। নদীর আশপাশে অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিতে হবে। নগরীর সব খাল নিয়মিত খনন এবং রাস্তার পাশে নালার গভীরতা ও প্রশস্ততা বাড়াতে হবে। জলাশয়, ডোবা ও পুকুর ভরাটের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। গৃহস্থালি ময়লা-আবর্জনা নালা-নর্দমার মাধ্যমে খাল ও নদীতে চলে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। ময়লা ব্যবস্থাপনায় নজরদারি জোরদার করতে হবে।
পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা, খাল ও নালা-নর্দমার অপদখল এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন। নতুন তিনটি খাল খনন এবং খালগুলোর অপ্রয়োজনীয় বাঁক সংশোধন করে সোজা করা প্রয়োজন।
পাহাড়ের বালু রোধে সিলট্র্যাপ (পাহাড়ি বালু আটকানোর ফাঁদ) করা প্রয়োজন। জোয়ারের পানি ঠেকানোর জন্য জোয়ার প্রতিরোধক ফটক নির্মাণ প্রয়োজন। সাগর ও নদীর কাছাকাছি নিচু এলাকায় জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে। নালা ও খালের ভিতর থাকা সেবা সংস্থার পাইপলাইন সরিয়ে নিতে হবে। নালা-নর্দমা ও খালগুলোর কারিগরি ত্রুটি সংশোধন করতে হবে। নালা-নর্দমা ও খালে যাতে কেউ আবর্জনা ফেলতে না পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে।
জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলের কার্যালয়গুলোকে সক্রিয় ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। এটি প্রণয়নের পর অনেক সময় চলে গেছে। এখন এই মহাপরিকল্পনাকে সংশোধন ও পরিমার্জন করতে হবে।
সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্বে সিডিএ, বন্দর, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সব সেবা সংস্থার সমন্বয়ে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষে এই সমস্যা সমাধান করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাদের যে বাজেট, তাতে তাদের পক্ষে কঠিন। এ জন্য সরকারি সব সংস্থা, যেমন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে।
আশার আলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
নগরীর দীর্ঘদিনের বড় সমস্যা জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে চার উপদেষ্টাকে বিশেষ দায়িত্ব দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সফর করেন।
আরও পড়ুন: কুকি-চিনের উত্থান বনাম বান্দরবানের পর্যটন: ক্ষতির পাহাড়
চার উপদেষ্টা হলেন—পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
দায়িত্ব পেয়ে চার উপদেষ্টা চট্টগ্রাম এসে নালা, খাল পরিদর্শন করে আটটি স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে খাল-নালা সংস্কার ও মাটি অপসারণ করা হয়েছে। এর ফলে কমেছে জলাবদ্ধতা। সবশেষ গত কয়েক দিন টানা বৃষ্টি হয়েছে।
এতে নগরীর নিম্নাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। তবে নগরীর বেশ কয়েকটি এলাকায় এবার তেমন জলাবদ্ধতা দেখা যায়নি। খাল ও নালা পরিষ্কার করায় এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে পুরো নগরীতে জলাবদ্ধতা নিরসনে আরও এক থেকে দেড় বছর লাগবে, তখন পুরোপুরি সুফল মিলবে বলে জানিয়েছেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
১৫৭ দিন আগে
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতিতে কি ‘উইন-উইন’ অবস্থান হারাচ্ছে বাংলাদেশ?
এপ্রিলে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭ শতাংশ বাণিজ্য শুল্ক মাত্র ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ ‘উইন-উইন’ অবস্থান হারিয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্কারোপ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যা কার্যকর হবে আগামী ১ আগস্ট থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের এই বড় শুল্কের বোঝা পড়বে দেশের পোশাকখাতের ওপর, যেখানে এ খাতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের শুল্ক ৪৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে।
এপ্রিলে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর আলোচনার জন্য বাংলাদেশ ৯০ দিন সময় পেলেও কেন সুবিধা করতে পারল না, এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক মাহফুজ কবির বলেন, ‘এতদিন আমরা উইন-উইন অবস্থান নিয়ে ভেবেছিলাম, সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। ৯০ দিনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর আলোচনা হয়েছে বলে মনে হয়নি। যদিও আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তবে বাংলাদেশকে যা করার এক সপ্তাহের মধ্যেই করতে হবে।’
ভিয়েতনাম বড় অঙ্কের শুল্ক কমিয়ে এনেছে। এখন যদি ভারত-পাকিস্তান আলোচনার টেবিলে নিজেদের সুবিধা আদায় করে নিতে সক্ষম হয় এবং বাংলাদেশ যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিতে পারে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্কারোপ ট্রাম্পের, ১ আগস্ট থেকে কার্যকর
শুল্ক কমানো প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চিঠির জবাব দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের শুল্ক ও অশুল্ক নীতিসমূহ এবং বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতার কারণে যে দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী বাণিজ্যঘাটতি তৈরি হয়েছে তা থেকে সরে আসতে হবে। ২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো বাংলাদেশের যেকোনো ধরনের পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা সব খাতভিত্তিক শুল্কের অতিরিক্ত হিসেবে প্রযোজ্য হবে।
উচ্চ শুল্কহার এড়াতে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে পণ্য পাঠানো হলে তার ওপরও উচ্চ শুল্কহার আরোপ হবে। ৩৫ শতাংশ শুল্ক বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বাণিজ্য ঘাটতি আছে, তার তুলনায় অনেক কম বলে জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যদি বাংলাদেশ এই শুল্কের জবাবে আরও শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ শতাংশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করবে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাধা দূর করতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশ মনে করছেন, দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেও এত স্বল্প সময়ে শুল্ক কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। বিশেষ করে শুল্ক কমাতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, তা যথেষ্ট আকর্ষণীয় নয় বলে মনে করছেন তারা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) পরিচালক আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘এলপিজি, সয়াবিন ও তুলা নিয়ে বাংলাদেশ যেসব সুবিধার প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছে তা দেশটির কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়নি। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় পোশাক কোম্পানিগুলো আগাম পোশাক মজুদ করে রেখেছে। এতে করে সামনে পোশাকের অর্ডার কমে যাবে। সমাধানে আসতে হাতে যা সময় আছে তা একেবারেই কম। এতে করে নতুন সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল।’
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উভয়ের জন্য লাভজনক শুল্ক চুক্তির আশায় ঢাকা: শফিকুল আলম
তবে শুল্ক কমে আসার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছেন, বাণিজ্য উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। প্রতিনিধিদলের সঙ্গে যোগ দিতে আজই ঢাকা ছাড়ছেন বাণিজ্য সচিব। রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের (ইএসটিআর) সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আগামীকাল শুল্ক প্রসঙ্গে আবারও আলোচনা হবে।
‘ওয়ান টু ওয়ান নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে’ শুল্ক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-জুন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৭.৬০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা ওই সময়ের মোট রপ্তানির ১৭.০৯ শতাংশ।
এ সময়ে বাংলাদেশের ওভেন পোশাকের ২৫.৯৩ শতাংশ, নিট পোশাকের ১১.৭১ শতাংশ ও হোম টেক্সটাইলের ১৬.১২ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতিতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা পোশাক খাতে আসবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ফজলে শামীম এহসান গতকাল (মঙ্গলবার) বলেন, ‘আগামীকালের (বুধবার) মিটিংয়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। মিটিং ফলপ্রসূ হলে শুল্ক কমে আসার বড় সম্ভাবনা আছে।’
শামীম জানান, যদিও ভারতের ওপর আরোপিত শুল্ক ২৭ শতাংশ, তবে ট্রাম্প ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর ওপর আলাদা ১০ শতাংশ শুল্কারোপ করতে পারেন। যদি চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক সমঝোতায় পৌঁছায় তাহলে বাংলাদেশ বিপদে পড়বে। কিন্তু চীন আর ভারতের ওপর উচ্চ শুল্কহার বহাল থাকলে, বিশেষ করে চীনের ওপর শুল্কারোপ অব্যাহত রাখলে বাংলাদেশের এখনো বাণিজ্য সুবিধা নেওয়ার সুযোগ আছে।
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনা থেকে ইতিবাচক ফলের আশা অর্থ উপদেষ্টার
১ আগস্টের পর শুল্ক বিষয়ে আর কোনো আলাপ-আলোচনার সুযোগ যুক্তরাষ্ট্র রাখবে কিনা সোমবার সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প নির্দিষ্ট করে কিছু জানাননি। তবে আলোচনার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি—এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি। এ অবস্থায় শুল্ক কমাতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা।
১৫৯ দিন আগে
বর্ষাকালেও হাওরে পানি নেই, ঋণের টাকায় নৌকা বানিয়ে দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা
সুনামগঞ্জের হাওরের মানুষ এখনো বলে, ‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও’, অর্থাৎ বর্ষাকালে নৌকা, শুকনোর সময় পা-ই ভরসা। কিন্তু এই বর্ষায় প্রবাদটির অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন না স্থানীয়রা। কারণ, হাওরে এখনো বর্ষা-বর্ষা ভাবটাই যে আসেনি!
বর্ষা মৌসুম শুরু হলেও পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে হাওরে এখনও আশানুরূপ পানি আসেনি। ফলে শান্তিগঞ্জ উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নের আক্তাপাড়া নৌকার হাটে বর্ষাকালেও চলছে ক্রেতা-খরা।
প্রায় তিন যুগ পুরোনো এই ঐতিহ্যবাহী নৌকার হাট বসে প্রতি শুক্রবার। হাওরাঞ্চলের যোগাযোগ, জীবিকা ও কৃষিকাজে গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে বজরা, হিল্লা, পাতামী ও বারকীসহ নানা ধরনের নৌকা কেনাবেচা হয় এখানে। অথচ এ বছর এখনও পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় শীত-গ্রীষ্মে শুকিয়ে যাওয়া নদী, খাল-বিল এখনও পানিশূন্যতায় ধুঁকছে। ফলে হাওর এলাকায় নৌকার প্রয়োজন এখনও সেভাবে না দেখা দেওয়ায় বাজারেও রয়েছে ক্রেতার অভাব।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাজারজুড়ে ৩-৪ শ’ নৌকা সাজানো রয়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় ক্রেতা প্রায় নেই বললেই চলে। তাই প্রতিবারের মতো নেই বেচাকেনার ধুম। ব্যবসায়ীরা দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু দাম ও পানির অভাবে তেমন সাড়া মিলছে না।
জানা যায়, এ বছর নৌকা তৈরির উপকরণের দামও বেড়েছে। কাঠের দাম বেড়ে গেছে আগের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ। একেকটি লম্বা নৌকা বানাতে যেখানে আগে খরচ হতো ৯ হাজার টাকা, এখন তা বেড়ে ১৫ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে।ি
আরও পড়ুন: গড়াই-তীর দখল করে চলছে অবৈধ নির্মাণ, নীরব প্রশাসন
বর্তমানে বারকী নৌকা বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকায়, পাতামী নৌকার দাম সেখানে ১৩ থেকে ১৫ হাজার, আর খিল্লা নৌকা পাওয়া যাচ্ছে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকায়। তবুও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বাড়িয়ে বিক্রি করলেও লাভ খুব বেশি হচ্ছে না। কারণ, উচ্চমূল্যে মানুষ নৌকা কিনছে না।
তাদের দাবি, ভরা মৌসুমে এই হাটে যেখানে গড়ে ১২০০ নৌকা বিক্রি হতো, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ৪০০টিতে। প্রতি সপ্তাহে গড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০টি নৌকা, যা আগের তুলনায় অনেক কম। নৌকার পাশাপাশি বৈঠার বাজারেও লেগেছে ধাক্কা।
আজমিরীগঞ্জ থেকে আসা বাছির মিয়া নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, আগে একেক হাটে ১ হাজার থেকে ১২০০ বৈঠা বিক্রি করতাম, এখন তা কমে এসেছে ২ থেকে ৩ শ’তে।
৬ হাতের বৈঠা আগে যেখানে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা ছিল, এখন তা ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
নৌকা বাজার ঘিরে এই অঞ্চলের পাঁচ শতাধিক পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হয়। কারিগর, কাঠ ব্যবসায়ী, বৈঠা বিক্রেতা, পরিবহন শ্রমিক ও ইজারাদারসহ অনেকে এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আষাঢ় মাস শেষ হতে চললেও এখনো বৃষ্টির পানিতে সুনামগঞ্জের নদী, খাল-বিল ভরে ওঠেনি। এদিকে, কেউ কেউ এনজিও বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নৌকা বানিয়ে থাকেন, নৌকার বাজারে জোয়ার না আসায় তারা এখন পড়েছেন আর্থিক চাপে।
শান্তিগঞ্জের রনশি গ্রামের নৌকা ব্যবসায়ী জুয়েল মিয়া বলেন, ‘এ বছর পানি নেই, তাই ৭০টা নৌকা বানিয়েছি। অথচ, আগে বানাতাম দেড়শ-দুইশটা। এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪০টা নৌকা বিক্রি হয়েছে। সারা দিন বসে থেকেও আশানুরূপ বিক্রি হয় না। ব্যাংক থেকে ঋণ করে নৌকা বানিয়েছি, অথচ লাভ তো দূরে থাক, ঋণ পরিশোধ করাই এখন বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে পড়েছে।’
আরও পড়ুন: সাঁকো ভেঙেছে এক মাস, সাঁতরে নদী পার হচ্ছে ৮ গ্রামের মানুষ
অন্যদিকে, ক্রেতাদের মনেও একই রকমের হতাশা বিরাজ করছে। হাটে আসা বরকাপন গ্রামের আজমান আলী ও রনশী গ্রামের আখলিস আলী বলেন, মাটি কাটা, মাছ মারা, ঘাস কাটা—সব কাজে নৌকা লাগে। কিন্তু পানি না থাকায় কাজও হচ্ছে না, তাই নৌকা কেনা হচ্ছে না। তার ওপর দাম বেশি, তাই হাত গুটিয়ে আছি।
বাজারের ইজারাদার মুরাদ চৌধুরী ও সামছুদ্দিন সুনু বলেন, সাধারণত এক মৌসুমে যদি অন্তত ৫টি শুক্রবার ভালো বেচাকেনা হয়, তাহলে আমাদের লাভ চলে আসে। সেখানে এ বছর মাত্র এক সপ্তাহে কিছুটা বেচাবিক্রি হয়েছে, বাকি প্রতিটি হাটেই আমাদের নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। তবে সামনে পানি বাড়লে নৌকাও বিক্রি বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা।
শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুকান্ত সাহা বলেন, ‘আক্তাপাড়া নৌকার হাট এই উপজেলার ঐতিহ্য। এর রক্ষণাবেক্ষণ বা সম্প্রসারণে কোনো সমস্যা হলে আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখব। বাজারে সোলার লাইটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে; পাশাপাশি সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার পরিকল্পনাও আছে। কিন্তু বৃষ্টির ওপর তো আমাদের হাত নেই!’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে কিছুদিনের মধ্যে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বৃষ্টি হলে নৌকা বিক্রি বাড়বে। আর ব্যবসায়ীদের মাঝেও স্বস্তি ফিরবে।’
১৬০ দিন আগে
গড়াই-তীর দখল করে চলছে অবৈধ নির্মাণ, নীরব প্রশাসন
কুষ্টিয়ার খোকসা পৌরসভার হাওয়া ভবন এলাকায় গড়াই নদীর তীরে সরকারি জমি দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী—মেসার্স আলম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী রুহুল আলম টুটুল।
প্রায় দুই মাস ধরে প্রকাশ্যেই চলছে অবৈধ নির্মাণকাজ। নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠছে পাকা ভবন। অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। তাদের ভাষ্য, প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। আর প্রশাসন যেন দেখেও দেখে না।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খোকসা-কমলাপুর সড়কের হাওয়া ভবন এলাকায় অবস্থিত মেসার্স আলম ট্রেডার্স। দোকানটির পেছনেই গড়াই নদী। নদীতীর ঘেঁষে পাকা ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। ভেতরে কয়েকজন শ্রমিককে কর্মরত অবস্থায় পাওয়া যায়।
জিজ্ঞাসা করা হলে নাম প্রকাশ করতে নিষেধ করে তাদের একজন বলেন, ‘ঘরের ভেতরে কয়েক ফুট সরকারি জমি পড়িছে। এই ব্যাপারে মালিক টুটুলের সঙ্গে কথা বলেন।’
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে টুটুল গড়াই নদীর পাড় দখল করে দালান তুলতিছে। ভয়ে কেউ কিছু কয় না। প্রশাসনও কোনো ব্যবস্থা নেয় না। মনে হয়, চোখ থাকতিও তারা অন্ধ।
১৬৩ দিন আগে
রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের ৩ স্থানে মৃত্যুফাঁদ, এক মাসে ৭ প্রাণহানি
রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের মিঠাপুকুর অংশের চার কিলোমিটারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথ এখন রীতিমতো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। এই অংশের অন্তত তিনটি স্থানে দীর্ঘদিন ধরে কোনো ট্রাফিক সিগন্যাল বা সড়ক পারাপারের ব্যবস্থা না থাকায় ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের, অনেকের জীবন বাঁচলেও দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে, দক্ষিণ এশীয় উপআঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা (সাসেক) প্রকল্পের আওতায় মহাসড়ক নির্মাণ হলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। ফলে সড়কে বেড়েছে দুর্ঘটনা।
এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে গড়ের মাথা চৌরাস্তা, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন-সংলগ্ন বৈরাতী রোড মোড় এবং উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম হাট এলাকা শঠিবাড়িতে।
ঝুঁকিপূর্ণ এসব স্থানে যথাযথ ট্রাফিক সিগন্যালের পাশাপাশি ফুট ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জনসাধারণ।
গড়ের মাথা
মিঠাপুকুর উপজেলা পরিষদ এবং থানা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্বে গড়েরমাথা নামক স্থানটি। এখানে চৌরাস্তা রয়েছে।
পশ্চিম দিক থেকে দিনাজপুর-ফুলবাড়ি কয়লাখনির সড়ক, পূর্ব দিক থেকে বালারহাট এলাকার সড়ক এসে গড়ের মাথা নামক স্থানে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এতে করে চৌরাস্তায় রূপ নিয়েছে এই স্থানটি।
অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম স্থানেও কোনো ফ্লাইওভার বা আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়নি। এমনকি নির্দিষ্টভাবে ট্রাফিক সিগন্যাল না থাকায় দূরপাল্লার যেকোনো যানবাহন চালকের বোঝার উপায় নেই যে সামনে চৌরাস্তা রয়েছে। ফলে প্রায়ই ঘটছে ছোটবড় দুর্ঘটনা।
বৈরাতী রোড
মিঠাপুকুর উপজেলার ইমাদপুর ইউনিয়ন থেকে মিলনপুর ইউনিয়ন পর্যন্ত একটি আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় দুই বছর আগে নির্মিত সড়কটি শঠিবাড়ি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন-সংলগ্ন রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, এখানে কোনো ওভারপাস নির্মাণ করা হয়নি। এর ফলে যানবাহনগুলোকে প্রায় দেড় কিলোমিটার ঘুরে মিলনপুর সড়কে উঠতে হয়। এ ছাড়া রংপুর থেকে আসা কোনো যাত্রী বা যানবাহন মিলনপুর ইউনিয়নের এই সড়কে যেতে চাইলে দেড় কিলোমিটার ঘুরে আসতে হয়।
সড়কের মাঝখানে বড় ইটের দেওয়াল নির্মাণ করে দুই ভাগে বিভক্ত থাকায় অনেকেই ট্রাফিক আইন মানছেন না। ফলে দ্রুতগামী যানবাহনের চাপায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারানোর পাশাপাশি পঙ্গুত্ব বরণ করার মতো ঘটনাও ঘটছে।
শঠিবাড়ি
উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় হাট শঠিবাড়ি। এই হাটকে মিঠাপুকুরের বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবেই জানেন স্থানীয়রা। ঐতিহ্যবাহী এই বাজারকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক।
নবনির্মিত এই মহাসড়কের মাঝখানে ইটের বড় দেওয়াল দিয়ে এই বিভক্তি তৈরি করায় ব্যবসায়ীরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেনই, সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও হারিয়েছে এলাকাটি।
এখানেও ওভারপাস বা ফ্লাইওভার না থাকায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এই এলাকায় ব্যাংক, বীমা, সরকারি অফিস, মার্কেট ও ছোটবড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সড়কের মাঝখানে নির্মিত কংক্রিটের দেওয়াল পারাপারের কোনো সেতুবন্ধন না থাকায় প্রতিদিন শত শত মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ব্যস্ততম এই হাট এলাকায় প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষ ও ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড় থাকে। অথচ এখানে কোনো ফুট ওভারব্রিজ বা কার্যকর আন্ডারপাস নেই। ফলে গত একমাসে অন্তত ৭ জন পথচারী দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
জনসাধারণ ও ব্যবসায়ীদের দাবি
শঠিবাড়ি হাটের ব্যবসায়ী শেখ সাদী, লালন ও রায়হান প্রধানসহ অনেকেরই অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, অথচ রাস্তা পারাপারে কোনো নিরাপদ ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, দেওয়াল টপকে মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে। শঠিবাড়ি স্কুলের সামনে একটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হলেও সেটি ব্যবহারযোগ্য নয় বলে দাবি তাদের।
তারা জানান, আন্ডারপাসটি এমন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে, সেখান দিয়ে সাধারণ মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। ফলে আন্ডারপাস থাকলেও তা কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
এলাকাবাসীর দাবি, দ্রুত এই এলাকায় ফুট ওভারব্রিজ অথবা আন্ডারপাস নির্মাণ করা হোক, যাতে জনগণের জীবন ও জীবিকা নিরাপদ থাকে।
নিরাপদ ও পরিকল্পিত যোগাযোগ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে প্রায় একই কথা জানান গড়ের মাথা ও বৈরাতী রোড এলাকার সাধারণ মানুষ।
বড়দরগা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘গত এক মাসে শঠিবাড়ি এলাকায় ১ নারীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়াও মিঠাপুকুরের অন্যান্য এলাকায় আরও ৩-৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমরা জনবহুল এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণ করার বিষয়ে সড়ক ও জনপদ বিভাগে অবগত করেছি। তবে দুর্ঘটনা রোধে জনগণকেও সচেতন হতে হবে।’
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবরে দুঃখপ্রকাশ করলেও আপাতত ফ্লাইওভার করার কোনো সুযোগ নেই বলে জানান রংপুর সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘তবে জনস্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ স্পটগুলোর বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করব।’
মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিল্লুর রহমান বলেন, ‘মহাসড়কে দুর্ঘটনা এড়াতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অবহিত করা হবে।’
১৬৪ দিন আগে
নারিতা ফ্লাইট বন্ধ: প্রবাসীদের ক্ষোভ, প্রশ্নবিদ্ধ বিমানের সিদ্ধান্ত
লোকসানের দোহাই দিয়ে মঙ্গলবার (১ জুলাই) থেকে বন্ধ করা হচ্ছে বিমানের বহুল আলোচিত নারিতা ফ্লাইট। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ফের চালুর মাত্র দেড় বছরের মাথায় এমন একটি ‘প্রেস্টিজিয়াস’ রুট বন্ধ করায় চরম সমালোচনার মুখে পড়েছে বিমান।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমন সিদ্ধান্তে চরম হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাপানে যাতায়াতকারী যাত্রী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা। যাত্রী চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বহুল প্রত্যাশিত এই রুট বন্ধ করে দেওয়াকে ‘হটকারী ও গর্হিত’ সিদ্ধান্ত বলে আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, চলমান বিপুল সম্ভাবনার বাস্তবতা উপেক্ষা করে এমন সিদ্ধান্ত বিমানের ভবিষ্যৎ রুট পরিকল্পনা ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এভাবে যদি হঠাৎ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বন্ধই করে দেওয়া হয়, তাহলে চালুরই-বা কী দরকার ছিল? লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ না করে বিমানের উচিত ছিল যেকোনো মূল্যে এটিকে হয় লাভজনক করা, কিংবা অন্তত লোকসান কমিয়ে আনা।
বিমানের এই সিদ্ধান্তে জাপানে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যে মুহূর্তে প্রধান উপদেষ্টা আগামী পাঁচ বছরে কমপক্ষে এক লাখ লোক জাপানে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিশ্চিত করেছন, ঠিক সে সময়ে নারিতার ফ্লাইট বন্ধ করার মানে কী? এখন যদি লোকসানও হয়, বিপুল সম্ভাবনার সুযোগ তো খুব নিকটেই। তাহলে কেন এই হটকারী সিদ্ধান্ত?
বেশ কয়েকজন জাপান প্রবাসী ইউএনবিকে জানান, দুনিয়ার এয়ারলাইন্সগুলো নতুন নতুন রুট খোলে এবং বহর বাড়ায়, আর আমাদের বিমান চলছে উল্টা পথে। দীর্ঘ ১৭ বছর পর ২০২৩ সালে যখন ঢাকা-নারিতা-ঢাকা রুটে সরাসরি ফ্লাইট চালু হয়, তখন অনেক খুশি হয়েছিলাম। কারণ এর আগে ট্রানজিট নিয়ে দেশে ফিরতে কোনো কোনো দেশের বিমানবন্দরে ২১ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। গত বছর সরাসরি ফ্লাইট চালুর পর আমরা মাত্র ৮ ঘণ্টায় দেশে ফিরতে পারতাম। সাময়িকভাবে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ হলেও আমাদের সেই আগের ভোগান্তিই পোহাতে হবে।
ঢাকা-নারিতা ফ্লাইটের একাল-সেকাল
দীর্ঘদিন স্থগিত থাকার পর ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা-নারিতা-ঢাকা রুটে ফের ফ্লাইট চালু করেছিল বিমান। এর আগে ১৯৮০ সালের ২৫ মে প্রথমবারের মতো এই রুটে ফ্লাইট চালু করে রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থাটি। পরে কয়েক দফা চালু ও বন্ধের মুখে পড়ে এটি। ২০০৬ সালে রুটটি একবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ফের চালু করা হয় নারিতা ফ্লাইট।
সে সময় অত্যাধুনিক ড্রিমলাইনার ৭৮৭ দিয়ে ফ্লাইট চালু করে বিমান। জাপান প্রবাসীদের মাঝেও তখন বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল। কারণ ওই সিদ্ধান্তের ফলে ঢাকা-জাপান যাতায়তে সময় কমে আসে মাত্র ৬ ঘণ্টায়।
শুরুতে ফ্লাইটে যাত্রীর সংখ্যাও ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে তা পর্যায়ক্রমে নিম্নমুখী হতে থাকে। তারপর বিমান পর্ষদ এ বছরের মে মাসে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ১ জুলাই থেকে নারিতা রুট বন্ধ করা হবে।
আরও পড়ুন: কক্সবাজার থেকে উড্ডয়নের পর খুলে পড়ল বিমানের চাকা
এর ফলে বাংলাদেশ থেকে জাপানে সরাসরি যেতে আর কোনো ফ্লাইট থাকছে না। যাত্রীদের এখন তৃতীয় দেশের ট্রানজিট ব্যবহার করতে হবে, যা খরচ ও সময়—উভয়ই বাড়াবে। তবে প্রায় দেড় বছর পর রুটটি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যাত্রীদের জন্য হতাশাজনক হলেও দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এটি ছিল প্রত্যাশিত।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বিমানের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম ইউএনবিকে বলেন, ‘নারিতা ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়াটা অত্যান্ত দুঃখজনক। একটি দেশে ফ্লাইট চালু করে তা আবার বন্ধ করা গর্হিত অন্যায়। জাপান বন্ধু দেশ, যেখানে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, প্রবাসীরা আছেন। বাংলাদেশের জন্য পর্যটনের বড় উৎস দেশ জাপান। জাপান ফ্লাইটে ট্রাফিক ভালোই ছিল, আরও চাহিদা বাড়ত। এর মধ্যেই বন্ধ করে দেওয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। শুরু করলে ফ্লাইট চালু রাখা উচিত।’
কাজী ওয়াহিদ বলেন, ‘মাথা ব্যথা হলে তো চিকিৎসা দিতে হবে। বিমান তো সেটা না করে এখন মাথাই কেটে ফেলতে চাইছে। নারিতা রুট দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর দেশি বিদেশি অংশীজন ও প্রবাসীদের দাবির মুখেই অনেক আশা-উদ্দীপনা নিয়ে চালু করা হয়। এবার লক্ষণও ভালো ছিল, কিন্তু মাত্র দেড় বছরের মাথায় বন্ধ করা দেওয়াটা একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় বোয়িং থেকে ব্র্যান্ড নিউ দশটি বিমান কিনেছিলাম। সেগুলো দিয়েই বিমান টিকে আছে। তারপর থেকে বিমান একটি প্লেনও কিনতে পারেনি। এমনকি একটি প্লেন লিজও নিতে পারেনি। পৃথিবীর অনেক এয়ারলাইন্সই প্রেস্টিজিয়াস রুটগুলোতে লোকসান দিয়ে হলেও চালু রাখে। একটি এয়ারলাইন্সও সব রুটেই শুধু লাভের আশায় ফ্লাইট চালায় না। দশটায় লাভ করবে, দুটোতে লোকসান দেবে—এটাই তো নিয়ম। পৃথিবীর অনেক এয়ারলাইন্স লোকসান দিয়ে নিউইয়র্ক, নারিতা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রেস্টিজিয়াস রুটগুলো চালু রাখে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিমান একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। যেকোনো দেশে ফ্লাইট চালুর আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা জরুরি। কিন্তু বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, নতুন যেসব রুটে বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে, তার কোনোটিরই সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। হুট করে সরকারপ্রধান মনে করলেন—নতুন একটি দেশের সঙ্গে বিমানের ফ্লাইট চালু করা দরকার, সেটিই করা হয়েছে। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই করা হয়নি। ফলে গত পাঁচ বছরে যেসব রুটে বিমানের নতুন ফ্লাইট চালু হয়েছে, এখন সবগুলো লোকসানে আছে।’
এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম ইউএনবিকে বলেন, ‘ইউএস বাংলা যদি এয়ারক্রাফট ক্রয় করতে পারে, বিমান পারে না কেন? সরকার কখন বিমান কিনে দেবে—এই আশায় তারা বসে থাকে।’
‘লোকসান হলেও নারিতা ফ্লাইট চালু রাখা দরকার ছিল। লোকসান তো হবেই। কারণ অন্যান্য এয়ারলাইন্স থেকে আমাদের বিমানের সিটগুলো কমফর্টেবল নয়। শুধু শ্রমিকদের বিবেচনায় ছিট রাখলে তো হবে না! অন্যান্য ভালো যাত্রীদের চাহিদা মোতাবেক ভালোমানের সিটও থাকা দরকার। তাহলে যাত্রী বাড়াবে।’
আরও পড়ুন: প্রশিক্ষণ বিমান আছড়ে পড়ল রানওয়েতে, অক্ষত দুই পাইলট
তিনি বলেন, ‘একটি দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক রেখেই দুই দেশের মধ্যে ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। তাহলে তড়িত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফ্লাইট চালু করলেন কেন? এখন আবার তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে বন্ধই-বা কেন করলেন? এতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হয়; দেশের বদনাম হয়। লাভ না হলেও বিমানের উচিত ছিল রান করা (চালু রাখা)। দুই বছর না চালিয়ে হঠাৎ করে বন্ধ করাটা ঠিক হয়নি। কীভাবে লাভ করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার ছিল।’
জাপানের যাত্রীদের এখন তৃতীয় কোনো দেশের ট্রানজিট ব্যবহার করতে হবে, যা খরচ ও সময় উভয়ই বাড়াবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ফ্লাইট বন্ধে বিমান কর্তৃপক্ষের ভাষ্য
এ বিষয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) মো. সাফিকুর রহমান ইউএনবিকে জানান, ক্রমাগত লোকসান হওয়ায় ১ জুলাই থেকে ঢাকা-নারিতা রুটে ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন রুট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঢাকা-নারিতা রুটটি কোনোভাবেই লাভজনক নয়। তাই বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটি বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
তার ভাষ্যে, ‘প্রতি ফ্লাইটে বিমানের ৯৫ লাখ টাকা লোকসান হয়। এভাবে তো আর লোকসান দেওয়া উচিত নয়। সে কারণে আপাতত বন্ধ করার সিদ্বান্ত নিয়েছে বিমান পর্ষদ।’
এই রুটে ফ্লাইট বন্ধের কারণ হিসেবে বিমান দেখিয়েছে ক্রমাগত লোকসানের মুখে ব্যবসায়িক বাস্তবতা, উড়োজাহাজ ও ক্রু স্বল্পতা।
সংস্থাটির তথ্য অনুসারে, ঢাকা-নারিতা-ঢাকা রুটে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ২২৫টি ফ্ল্যাইটের মাধ্যমে ৮৪ হাজার ৬৭৪ যাত্রী ও ২৩৬৫ টন কার্গো পরিবহন করে বিমান। এতে কেবিন ফ্যাক্টর ছিল শতকরা ৬৯ ভাগ। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২১৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, যা ফ্লাইটপ্রতি গড়ে ৯৫ লাখ ৮১ হাজার টাকা।
বিমানের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, নারিতায় সপ্তাহে দুটো ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়ে সেই ফ্লাইট দিয়ে ঢাকা-মাস্কাট, ঢাকা-দাম্মাম ও ঢাকা-মদিনায় অতিরিক্ত ১টি করে ফ্লাইট চালালে লাভ হবে মাসিক অন্তত ৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই একটি রুট বন্ধ করা হলে অন্য তিনটি রুটকে আরও লাভজনক করা সম্ভব হবে।
১৬৫ দিন আগে
কুকি-চিনের উত্থান বনাম বান্দরবানের পর্যটন: ক্ষতির পাহাড়
মেঘ, পাহাড়, নদী ও ঝর্ণার মিলনে অপরূপ জেলা বান্দরবান। এসব নান্দনিক দৃশ্যে চোখ জুড়াতে সারা দেশ থেকে পর্যটক আসেন এখানে। কিন্তু পাহাড়ে নতুন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) উত্থানের কারণে নিরাপত্তা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে দীর্ঘদিন কয়েক দফায় পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে পর্যটন শিল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
দেশের তিনটি পার্বত্য জেলার মধ্যে একটি বান্দরবান। জেলাটির দক্ষিণ-পশ্চিমে কক্সবাজার, উত্তর-পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা, উত্তরে রাঙামাটি ও পূর্বে মিয়ানমার।
নিষেধাজ্ঞার টাইমলাইন
২০২০ থেকে ২১ সাল পর্যন্ত কোভিড-১৯ মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই কেএনএফের তৎপরতার কারণে ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে স্থানীয় প্রশাসন।
এরপর ধারাবাহিকভাবে থানচি ও আলীকদম উপজেলাও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে দফায় দফায় উপজেলাভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রশাসন। নিষেধাজ্ঞা বাড়ানোও হয়েছে কয়েক দফায়।
এরপর ২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল। তবে, সে বছরের ১৬ মার্চ সে নিষেধাজ্ঞা আবারও জারি করা হয়। পরে, আবারও ২০২৪ সালের ৮ অক্টোবর বান্দরবান ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এরপর ৬ নভেম্বর জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে চার উপজেলায় ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও তিন উপজেলা—রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচিতে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা হয়।
আরও পড়ুন: পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের তৎপরতা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে
চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি রোয়াংছড়ির দেবতাখুম থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় পর্যটকেরা বর্তমানে সেখানে ভ্রমণ করতে পারছেন। ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ থেকে দুই বছরেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর চলতি ৬ জুন থেকে রুমায় বগা লেক পর্যন্ত এবং থানচিতে তুমাতুঙ্গি ও তিন্দু পর্যন্ত ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে, নির্দেশিত স্থানের বাইরে কোথাও যেতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
কেএনএফের উত্থান যেভাবে
বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কেএনএফ সংগঠনটি গড়ে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী নাথান বম সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো এমন তথ্যই দিয়েছে।
প্রথমে ২০১২ সালে কুকি-চিন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন্স (কেএনডিও) নামে সংগঠন করেন তিনি। পরে ২০১৮ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে, যদিও সংগঠনটির লোগোতে প্রতিষ্ঠাকাল উল্লেখ করা আছে ২০০৮ সাল।
শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিবাদ করত তারা। এ ছাড়া বম, লুসাই, পাংখো, খিয়াংসহ পিছিয়ে পড়া নৃগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা ও মারমাদের ব্যাপক বৈষম্যের প্রতিবাদ করছিল সংগঠনটি। তবে, কিছুদিন পর কেএনএফ আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যায়।
একপর্যায়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে তারা। রাঙামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের ছয়টি জাতিগোষ্ঠী—বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমিদের প্রতিনিধিত্ব করছে বলে নিজেদের ফেসবুক পেজে দাবি করে তারা।
গোষ্ঠীটি বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম এবং রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি—মোট ৯টি উপজেলা নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবি করে। এমনকি, কল্পিত রাজ্যটির মানচিত্রও তাদের পেজে আপলোড দেয় তারা।
কেএনএফের দাবি, তাদের সামরিক শাখার শতাধিক সদস্য গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে পাড়ি জমান বছর তিনেক আগে। ২০২১ সালে প্রশিক্ষণ শেষে একটি দল ফিরে এসে আত্মগোপনে চলে যায়। তবে তখন হয়তো ১৫ থেকে ২০ জনের মতো সদস্য ছিল বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
আরও পড়ুন: বান্দরবানে কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের হামলায় ২ সেনাসদস্য নিহত, আহত ২: আইএসপিআর
কেএনএফ শুরুতে তাদের ফেসবুক পেজে সরকারের কোনো দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নয়, বরং সব ক্ষোভ আঞ্চলিক পরিষদ, জেএসএস ও চাকমাদের ওপর চাপায়। এমনকি, বিভিন্ন মহল্লায় হামলা চালিয়ে চাকমাদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার নানা বার্তা দেয় তারা। এ সময়, তারা রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের একটি ত্রিপুরা গ্রামে দুজন জুম চাষিকে হত্যাও করে।
শুরুতে পাহাড়ে নতুন রাজ্যের দাবি করলেও বর্তমানে সেই অবস্থান থেকে সরে এসে স্বায়ত্বশাসন চাচ্ছে কেএনএফ। তবে, জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), আঞ্চলিক পরিষদ ও চাকমাবিদ্বেষের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাদের মতে, পাহাড়ে ‘চাকমা কর্তৃত্ব’ চলমান রয়েছে।
কেএনএফের তৎপরতা
ফেসবুকে পেজে ঘোষণা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল কেএনএফ। এরপর থেকে চাঁদাবাজি ও গুম-খুন অপহরণের মাধ্যমে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করে তোলার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে।
একপর্যায়ে অভিযোগ পাওয়া যায়, দুর্গম পাহাড়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) গোপন আস্তানায় প্রশিক্ষণশিবির স্থাপন করেছে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার জঙ্গিরা।
এই তথ্যের ভিত্তিতে ২০২২ সালের ৩ অক্টোবর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযান শুরু হয়। এরপর একই বছরের ১৭ অক্টোবর থেকে পর্যটক ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
পরে সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসার কথা থাকলেও ২০২৪ সালে বান্দরবানের দুই উপজেলায় ১৭ ঘণ্টার ব্যবধানে দুই ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতি করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।
আত্মপ্রকাশের পর থেকে অন্তত নয়টি বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে কেএনএফ। একই বছর পাহাড়ের আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সঙ্গে সংঘর্ষে রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাংপাড়া এলাকায় ৮ জন ও রুমা উপজেলার মুয়ালপিপাড়া একজন নিহত হন।
এ ছাড়া, ২০২৩ সালের ৮ মে রোয়াংছড়ি উপজেলা পাইংখিয়ংপাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগের একজন নেতাসহ বম জনগোষ্ঠীর তিনজন এবং ২০২৩ সালের ২২ মার্চ একই উপজেলার রামথারপাড়ায় থংচুল বম নামের এক কারবারিকে (পাড়াপ্রধান) গুলি করে হত্যা করা হয়।
আরও পড়ুন: বান্দরবানে কুকি-চিন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গুলিতে সেনা ওয়ারেন্ট অফিসার নিহত
২০২২ সালের ২১ জুন রাঙামাটির বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় তিন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে তারা।
জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানের সময় কেএনএফের অনেক সদস্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের মিজোরামে চলে যান। এতে বম জাতিগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ পড়েন বিপাকে। এর সুযোগ নেয় কেএনএফ। তখন নতুন করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যুবকদের তারা দলে ভেড়ায় বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
২০২৩ সালে পাহাড়ে যৌথ অভিযানের সময় কেএনএফের ২ সদস্য ও কেএনএফের গুলিতে সশস্ত্র গ্রুপ মগ পার্টির ৩ জন নিহত হন। একই বছরের ১২ মার্চ দুপুরে কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যদের গুলিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং দুজন সেনা সদস্য আহত হন। তার একদিন আগে থানচি থেকে কেএনএফ ১২ জন নির্মাণ শ্রমিককে অপহরণ করে। তাদের মধ্যে একজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হন এবং বাকিদের জিম্মি করে রাখা হয়।
২০২৪ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল রুমা ও থানচিতে তিনটি ব্যাংকে ডাকাতি করে কেএনএফ। তারপর ৬ এপ্রিল থেকে সন্ত্রাস দমনে নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান শুরু করে।
বান্দরবান পুলিশ সুপার কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, কেএনএফের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ২৮টিরও বেশি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রুমা থানায় ১৮টি, থানচিতে ৬টি, রোয়াংছড়িতে ৩টি ও সদর থানায় একটি মামলা হয়েছে।
এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে রুমায় ১১ জন, রোয়াংছড়িতে ৫ জন, বান্দরবান সদরে ২ জন ও থানচিতে ১ জনসহ মোট ১৯ জন কেএনএফ সদস্য নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া, পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ২৬টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।
কয়েক বছরেও ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব না!
বান্দরবান হোটেল-মোটেল মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বান্দরবান সদরে ৭৪টিসহ মোট দেড় শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট-কটেজ রয়েছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে দীর্ঘদিন বান্দরবানে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছে সেখানকার পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো।
বান্দরবান হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ইউএনবিকে বলেন, ‘করোনা ও এরপর পাহাড়ের অভ্যন্তরীণ কিছু গ্রুপ, বিশেষ করে কেএনএফের কারণে আমাদের অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমরা কয়েক বছরেও এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারব না।’
তিনি বলেন, ‘তবে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে পর্যটক আসতে না পারায় এবারের কোরবানি ছুটিতে প্রচুর পর্যটক এসেছে।’
কুকি-চিন নিয়ে নিরাপত্তা হুমকি নেই জানিয়ে পর্যটকদের বান্দরবান ভ্রমণে যাওয়ার আমন্ত্রণও জানিয়েছেন এ ব্যবসায়ী।
বর্তমান পরিস্থিতি
চলতি বছরের ২ জুন কেএনএফের ইউনিফর্ম তৈরির জন্য কাপড় সরবরাহের অভিযোগে চট্টগ্রামে ওয়েল কম্পোজিট নিট নামের একটি ফেব্রিক্স কারখানায় অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরিকুল ইসলামসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এর আগে, গত ১৭ মে নয়াহাটের রিংভো অ্যাপারেলস থেকে ২০ হাজার ৩০০ পিস এবং পরের দিন একটি গোডাউন থেকে ১১ হাজার ৭৮৫ পিস কেএনএফ ইউনিফর্ম জব্দ করা হয়। সর্বশেষ ২৮ মে পাহাড়তলীর নূর ফ্যাশন কারখানা থেকে আরও ১৫ হাজার পিস ইউনিফর্ম জব্দ করা হয়।
এ পর্যন্ত কেএনএফের ৪৭ হাজারের বেশি ইউনিফর্ম জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত এক মাসে কেএনএফের এক হাজার ৯৭৯ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তারদের সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে। গত ২৬ মে সেনাসদরে আয়োজিত বিশেষ ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানানো হয়।
আরও পড়ুন: বান্দরবানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কুকি চিনের সংঘর্ষ, নিহত ১
বান্দরবানে পর্যটন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, ‘দর্শনীয় স্থানগুলোতে এখন কোনো পর্যটন নিষেধাজ্ঞা নেই। যেসব জায়গা পর্যটকদের জন্য খোলা হয়েছে, সেসব জায়গায় নিরাপত্তাজনিত কোনো শঙ্কাও নেই।’
সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যৌথ অভিযান এখনো চলমান রয়েছে।’
১৬৭ দিন আগে
মোসাদ-সংশ্লিষ্ট সন্দেহে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে ইরানে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
ইরান ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা সন্দেহে ব্যাপক গ্রেপ্তার অভিযান চালিয়েছে তেহরান। এর পাশাপাশি একাধিক অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করেছে ইরান সরকার।
ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ইসরায়েলি এজেন্টদের অনুপ্রবেশের পর এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা।
ইরান সরকারের অভিযোগ, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) শীর্ষ কমান্ডার ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের টার্গেট করে হত্যাসহ যুদ্ধ চলাকালীন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলের কাছে সরবরাহ করা তথ্যই ভূমিকা রেখেছে।
এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে দায়ী করেছে তেহরান। তারা ইরানের ভেতর থেকেই এসব পরিচালনা করেছে বলে দাবি দেশটির।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডগুলোর ব্যাপকতা ও নিখুঁত বাস্তবায়নে হতবাক ইরানি কর্তৃপক্ষ। এ কারণে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এখন যেকোনো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে ইরান।
তবে এসব পদক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে ভিন্নমত দমন ও জনগণের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হয়ে উঠছে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
এদিকে, ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনব্যাপী সংঘাতের সময় তাদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ইরান সরকার। যুদ্ধবিরতির পরদিন ২৫ জুন এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এরপর থেকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ রয়েছে—এমন শত শত সন্দেহভাজনের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এমনকি আটক কয়েকজনের বক্তব্যও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছে। সেখানে তাদের ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের সঙ্গে কাজ করার কথা স্বীকার করতে দেখা যায়।
এদিকে, চলমান এই অভিযানে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠনগুলো।
তারা বলেন, ইরানের বিচারব্যবস্থায় জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি গ্রহণ ও অন্যায্য বিচারের ইতিহাস রয়েছে। তাছাড়া, আরও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
অন্যদিকে, ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সিআইএ, মোসাদ ও এমআই৬-এর মতো পশ্চিমা ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ‘নিরলস লড়াই’ চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
আইআরজিসি সঙ্গে সম্পৃক্ত ফার্স নিউজ এজেন্সির তথ্য অনুসারে, ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানে হামলা শুরু করার পর থেকে ইসরায়েলি গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ইরানেরর ভেতরে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সংঘাতের ১২ দিনে এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত সাত শতাধিক ব্যক্তিকে ইরানি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে বলেও দাবি করেছে তারা।
বিবিসি ফারসিকে ইরানের কয়েকজন নাগরিক জানিয়েছেন, তারা ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় থেকে হুঁশিয়ারিমূলক বার্তা পেয়েছেন। সেখানে তাদের ফোন নম্বর ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়া পেজে পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের এসব পেজ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, না হলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
বিবিসি ফারসি, লন্ডনভিত্তিক ইরান ইন্টারন্যাশনাল ও মানোতো টিভিসহ দেশের বাইরের ফারসি ভাষার গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের ওপরও ইরান সরকার চাপ বাড়িয়েছে বলে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
ইরান ইন্টারন্যাশনালের অভিযোগ, সম্প্রতি তাদের একজন নারী উপস্থাপিকার মা, বাবা ও ভাইকে তেহরানে আটক করেছে আইআরজিসি। চ্যানেল থেকে ওই উপস্থাপিকাকে পদত্যাগ করার জন্য তার বাবাকে দিয়ে ফোন করিয়ে আহ্বান জানানো হয়। এমনকি পদত্যাগ না করলে আরও কঠোর পরিণতির হুমকি দেওয়া হয়।
যুদ্ধ শুরুর পর বিবিসি ফারসির সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের প্রতি হুমকি আরও বেড়ে গেছে বলে দাবি করেছে সংবাদ মাধ্যমটি।
ইরানি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে যুদ্ধাবস্থায় পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করাও ন্যায্য—এমন হুমকি দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন সাংবাদিক।
এসব সাংবাদিককে ‘মোহারেব’ বা ‘আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে’ এমন ব্যক্তি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে যা ইরানি আইনে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ।
সাংবাদিকদের পরিবারের প্রতি হুমকি এবং চ্যানেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করার প্রচেষ্টার মতো ঘটনার কথা জানিয়েছে মানোতো টিভিও।
এসব পদক্ষেপ মূলত ভিন্নমত দমন ও নির্বাসিত সংবাদকর্মীদের ভয় দেখানোর একটি বৃহৎ কৌশলের অংশ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বহু অধিকারকর্মী, লেখক ও শিল্পীকেও আটক করেছে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী। অনেক ক্ষেত্রে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছাড়াই তাদের করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এমনকি ২০২২ সালের ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ আন্দোলনের সময় নিহতদের পরিবারের সদস্যদেরও আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, কেবল বর্তমান আন্দোলন নয়, আগের আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালানো হচ্ছে বলে ইঙ্গিত দেয় এসব পদক্ষেপ।
যুদ্ধ চলাকালে সরকার ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকারে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। যুদ্ধবিরতির পরও পূর্ণ প্রবেশাধিকার এখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি।
দেশজুড়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ এখন ইরানের একটি সাধারণ কৌশলে পরিণত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইরানে ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রাম, এক্স ও ইউটিউবসহ অধিকাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম এবং বিবিসি ফারসিসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধ। সেগুলো কেবল ভিপিএন বা প্রক্সি সার্ভিস ব্যবহার করেই দেখা যায়।
এসব ঘটনায় আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমানের এসব পদক্ষেপের মিল খুঁজে পাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার-কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সে সময় রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মমভাবে দমন করেছিল ইরান সরকার।
ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের পর আন্তর্জাতিক পরিসরে দুর্বল হয়ে পড়া ইরান হয়তো আবার দেশের অভ্যন্তরেই ব্যাপক গ্রেপ্তার, মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে কঠোর দমন-পীড়নের পথে হাঁটছে—এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেকে।
ইরানের এসব কর্মকাণ্ডের সমালোচকরা ১৯৮৮ সালের ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, সে সময় সংক্ষিপ্ত ও গোপন বিচার শেষে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল আগেই সাজাপ্রাপ্ত। ওই সময়ে অধিকাংশকে পরিচয়হীন গণকবরে দাফন করা হয়েছিল। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছিল।
আরও পড়ুন: সংঘাত থেকে কী পেল ইরান-ইসরায়েল?
১৭০ দিন আগে