বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক উদ্বাস্তু শিবিরে জন্ম ও বেড়ে উঠা ১৯ বছর বয়সী রহিমা, যার ডাক নাম খুশি, আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ এক হাসি দিয়ে জানান- তার প্রত্যাশা হলো বিশ্বে সবচেয়ে শিক্ষিত রোহিঙ্গা নারী হওয়া।
এক সময়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাহাড়ের কোলে বাঁশ ও তেরপল দিয়ে তৈরি অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে রহিমার জন্ম এবং সেখানেই তিনি কাটিয়েছেন তার পুরোটা জীবন।
১৯৯০’র দশকের শুরুর দিকে জোরপূর্বক শ্রম, ধর্মীয় নিপীড়ন ও বৌদ্ধ জনতার সহিংস হামলা থেকে বাঁচতে যে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন তাদের মাঝে ছিল রহিমার বাবা-মা।
উদ্বাস্তু শিবির থেকে পরিত্রাণের জন্য শিক্ষাকে নিজের টিকিট মনে করছেন রহিমা। তার ভাষায়, ‘যদি আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি তাহলে জীবনের মতো জীবন ধারণ করতে পারব।’
২০১৭ সালের আগস্ট থেকে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর শিবির এলাকায় কাজ করতে আসা সাহায্য সংস্থার কর্মী ও সাংবাদিকদের দোভাষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে পরিবারের আয়ে অবদান রাখছেন রহিমা।
জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গত মাসে তাদের প্রতিবেদনে জানায়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধদের চালানো নতুন সহিংসতায় কমপক্ষে ১০ হাজার রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। জাতিসংঘ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মিয়ানমারের শীর্ষস্থানীয় জেনারেলদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে।
অন্যদিকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে নিরাপত্তা পেলেও শিক্ষা পাওয়ার নিশ্চিয়তা থেকে তারা অনেক দূরে রয়ে গেছে।
রহিমা আক্তার জানান, তিনিসহ মাত্র অল্পকিছু রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু মেয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের সমমানের বাংলাদেশি শিক্ষা সম্পন্ন করতে পেরেছেন। এই কৃতিত্ব অর্জনের জন্য তাকে শিবিরের তল্লাশি চৌকি ফাঁকি এবং ভর্তির জন্য সরকারি বিদ্যালয়ের বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়েছে।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, শিবিরে পাঁচ লাখের অধিক রোহিঙ্গা শিশু রয়েছে। তাদের মধ্যে ছয় থেকে ১৪ বছর বয়সী এক লাখ ৪০ হাজার শিশুকে ১২শ অস্থায়ী বিদ্যালয়ে ইংরেজি, গণিত, বার্মিজ, বিজ্ঞান ও চারুকলা শেখানো হচ্ছে।
কিন্তু বিদ্যালয়গুলোতে পাড়ানো হয় মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। তাই রহিমা ও অন্য উদ্বাস্তুদের পড়াশুনা সম্পন্ন করার জন্য গোপনে কক্সবাজার ও অন্যান্য শহরের বিদ্যালয়ে ভর্তি নিতে হয়।
শিক্ষার সীমিত সুযোগের জন্য ইউনিসেফ এই উদ্বাস্তু শিশুদের নাম দিয়েছে ‘হারানো প্রজন্ম’। তাদের জন্য কিছু করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য ইউনিসেফের মুখপাত্র শাকিল ফয়জুল্লাহর।
তিনি জানান, তাদের সংস্থা উদ্বাস্তু বড় শিক্ষার্থীদের মৌলিক ক্লাস শুরু করানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। তারা মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করবে- সেই অনুমান থেকে এই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
তবে রহিমা জানান, বর্তমানে মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাবিরোধী পরিস্থিতির মাঝে তার পরিবারের ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।
তিনি আরো জানান, বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য নিজের রোহিঙ্গা পরিচয় আড়াল করতে তিনি শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলেন এবং বাংলাদেশি মেয়েদের মতো পোশাক পরেন। তবে তাকে সবচেয়ে প্রতিকূল লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয় নিজের ঘরে।
বেশির ভাগ রোহিঙ্গা মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৬ বছরের মধ্যে, মাঝেমধ্যে তা ১৪ বছরেও হয়। তাই রহিমাকে লড়াই করতে হয় তার বাবার সাথে, যিনি মনে করেন রহিমার এখন বিয়ের বয়স হয়েছে। লেখাপড়া চালিয়ে নেয়ার জন্য রহিমা অনেক দিন ধরে কেঁদেছেন এবং তার বাবা-মায়ের কাছে করজোড়ে অনুনয় করেছেন।
রহিমার মা মিনারা বেগম শিশুকালে মিয়ানমার থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে পালিয়ে আসেন এবং কখনো বিদ্যালয়ে যাননি। তিনি তার বড় মেয়েকে পড়ানোর জন্য শুধু স্বামীকেই বোঝাননি, সেই সাথে নিজ সম্প্রদায়ের বয়স্কদের লাঞ্ছনাও প্রতিহত করেছেন, যারা মনে করেন মেয়েদের বাইরের দুনিয়ায় পাঠানো পাপ।
মিনারা বেগম এখন তার চার মেয়ের তিনজনকে বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন এবং তার আশা, সবচেয়ে ছোট মেয়ে ও একমাত্র ছেলেকেও শিক্ষিত করবেন।
রহিমা আক্তার ও তার দুই বোন এখন কক্সবাজারে তাদের বিদ্যালয়ের পাশে নিজেদের মতো করে বাস করছেন, যা শিবির থেকে গাড়িতে করে দুই ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। রহিমা বাংলাদেশি বিদ্যালয়ে জায়গা করে নেয়ার পর তার দুই বোনও ভর্তি হতে পেরেছে।
মিনারা বেগম জানান, সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর খরচ মেটানোর জন্য তাদের খাদ্যের ওপর ব্যয় কমাতে হয়েছে। তারপরও তার আশা, সন্তানরা নিজেদের ভবিষ্যত তৈরি করে নিতে পারবে, যাতে উদ্বাস্তু হওয়ার কলঙ্ক লেগে থাকবে না।
‘আমরা রোহিঙ্গা। আমাদের পায়ের নিচে কোনো মাটি নেই। আমাদের কোনো ভবিষ্যত নেই। আমাদের অবস্থা খাঁচায় থাকা মুরগির মতো। আমরা এমনকি যে গাছ লাগিয়েছি তার ফলও দাবি করতে পারি না,’ যোগ করেন মিনারা বেগম।
সন্তানদের পড়াশুনা করানোর বিষয়ে মিনারার যে নিষ্ঠা তা ইতিমধ্যে প্রতিদান দিতে শুরু করেছে। রহিমা এখন যে অর্থ আয় করছেন তা পুরো পরিবারের মোট আয়ের চেয়েও বেশি।
রহিমা এখন বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে। সেই সাথে ঘরে ঘরে গিয়ে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের তথ্য সংগ্রহ করছেন তিনি। তার পরিকল্পনা, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মানবাধিকার নিয়ে পড়াশোনা এবং চূড়ান্তভাবে তার গবেষণা প্রকাশ করা।
‘কেন এমন পরিস্থিতিতে মানুষকে জীবন ধারণ করতে হবে? হয়তো একদিন রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার বিষয়ে আমি আওয়াজ তুলতে পারব,’ যোগ করেন রহিমা।