সম্প্রতি বনের বিভিন্ন অংশে গাছে রঙ লাগিয়ে অভয়ারণ্য এলাকা চিহ্নিত করা হয়। অভয়ারণ্য এলাকা থেকে সব ধরনের বনজ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওই এলাকায় জেলে-বাওয়ালিদের সব ধরনের বিএলসি (পাস) বন্ধ করে দিয়েছে বন বিভাগ।
এলাকা সম্প্রসারণের কারণে সুন্দরবনের মোট আয়তনের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা এখন অভয়ারণ্যভুক্ত। বর্তমানে সুন্দরবনের তিন লাখ ১৭ হাজার ৯৫০ দশমিক ৮ হেক্টর অভয়ারণ্য এলাকা।
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় গড়ে উঠেছে বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবন। ১৮৭৮ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবনের মোট আয়তন ছয় হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থলভাগের পরিমাণ চার হাজার ১৪৩ বর্গ কিলোমিটার এবং জলভাগের পরিমাণ এক হাজার ৮৭৩ বর্গ কিলোমিটার।
সুন্দরবন জীববৈচিত্র্য বিশ্বের মধ্যে সমৃদ্ধশালী একটি ইকোসিস্টেম। অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল সুন্দরবন বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থলও এটি।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে সুন্দরবনের এক লাখ ৩৯ হাজার ৬৯৯ দশমিক ৪৯৬ হেক্টর এলাকা অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। তখন যা ছিল সুন্দরবনের মোট আয়তনের শতকরা ২৩ ভাগ। এর ২১ বছর পর ২০১৭ সালের জুলাই মাসে সরকার সুন্দরবনে অভয়ারণ্য এলাকা সম্প্রসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনে নতুন করে বনের আরো এক লাখ ৭৮ হাজার ২৫০ দশমিক ৫৮৪ হেক্টর এলাকা অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সব মিলে বর্তমানে সুন্দরবনে মোট তিন লাখ ১৭ হাজার ৯৫০ দশমিক ৮ হেক্টর এলাকা অভয়ারণ্য। সেই হিসেবে এখন সুন্দরবনের মোট আয়তনের শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি অভয়ারণ্য এলাকা।
বন বিভাগ জানায়, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন ৯১ হাজার ৬৯৩ দশমিক ৯৬২ হেক্টর, সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের খুলনা রেঞ্জের আওতাধীন এলাকায় ৩৮ হাজার ৩৩৯ দশমিক ৮৪৫ হেক্টর এবং সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন এলাকায় ৪৮ হাজার ২১৬ দশমিক ৭৭৭ হেক্টর সম্প্রসারিত বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকা।
খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী ইউএনবিকে জানান, সুন্দরবনের অভয়ারণ্য এলাকা থেকে সব ধরনের বনজ সম্পদ আহরণ বন্ধ রয়েছে। সুন্দরবনে মানুষের চাপ অনেকটা কমেছে। এতে করে সুন্দরবনে বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণী, জলজপ্রাণী এবং গাছপালাসহ সব ধরনের বনজসম্পদ বৃদ্ধি পাবে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তনের শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি এখন অভয়ারণ্য বলে তিনি জানান।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. মাহমুদুল হাসান জানান, সুন্দরবনে সম্প্রসারিত অভয়ারণ্য এলাকার সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে ওই সব এলাকায় প্ল্যাকার্ড ও সাইনবোড ঝুলিয়ে দেয়া হবে। অভয়ারণ্য এলাকা থেকে সব ধরনের বনজ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ। কোনো অবস্থাতেই অভয়ারণ্য এলাকা থেকে কোনো ধরনের বন সম্পদ আহরণ করতে দেয়া হবে না।
তিনি আরো জানান, সুন্দরবন থেকে আগে বনজসম্পদ আহরণে বিএলসি (পাস) দেয়ার ক্ষেত্রে সংখ্যার কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু এখন পাস দেয়ার ক্ষেত্র সীমিত করা হয়েছে। গোটা সুন্দরবনে মাত্র ১২ হাজার পাস দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বনের ওপর থেকে পেশাজীবীদের চাপ কমাতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
ডিএফও মো.মাহমুদুল হাসানের দেয়া তথ্য মতে, ৪০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সুন্দরবন সুরক্ষা’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ওই প্রকল্প বর্তমানে একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ওই প্রকল্প পাস হলে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল পেশাজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে বলে তিনি জানান।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড.মাহমুদ হোসেন জানান, সুন্দরবনে অভয়ারণ্য এলাকা সম্প্রসারিত করা বনের জন্য অবশ্যই সুসংবাদ। বনের ওপর থেকে মানুষের চাপ কমবে। আর অভয়ারণ্য এলাকা থেকে সব ধরনের বনজসম্পদ আহরণ বন্ধ রাখা গেলে সুন্দরবনে বনজ ও বন্যপ্রাণী এবং জলসম্পদ বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থান এবং তাদেরকে সচেতন করার কথা বলেন তিনি।
এদিকে অভয়ারণ্য এলাকা সম্প্রসারণ করায় বনের ওপর নির্ভরশীল ব্যবসায়ী ও জেলেরা চরমবিপাকে পড়েছেন।
সুন্দরবন ঘেষা বাগেরহাটের শরণখোলার মৎস্য ব্যবসায়ী জালাল মোল্যা জানান, সুন্দরবনে অভয়ারণ্য এলাকা সম্প্রসারণ করায় তার ব্যবসায় ধস নেমেছে। শরণখোলার ওই এলাকার অধিকাংশ নদ-নদী অভয়ারণ্যভুক্ত হওয়ায় জেলেরা জাল ফেলতে পারছে না। জেলেরা বেকার হয়ে পড়েছে এবং তারা বিকল্প কর্মসংস্থান খুঁজছে।
তিনি আরো জানান, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে মাছের ব্যবসা করে আসছেন তিনি। ৩৩টি নৌকার ১২০ জন জেলেকে তার ২৩ লাখ টাকা দাদন দেয়া রয়েছে। ওই সব জেলেরা সুন্দরবন থেকে মাছ ধরে তার কাছে বিক্রি করতো। কিন্তু মাছ ধরার জায়গা না থাকায় জেলেরা ফিরে এসেছে।
শরণখোলা উপজেলার খুড়িয়াখালী গ্রামের আলামিন মুন্সি জানান, ১৬ বছর ধরে তিনি সুন্দরবনে মাছ আহরণ করেন। ওই মাছ বিক্রি করে যে অর্থ পান তাই দিয়ে তার সংসার চলে। কিন্তু অভয়ারণ্যের কারণে সুন্দরবনের ওই এলাকায় মাছ ধরতে পারছেন না।
বনসংলগ্ন শরণখোলা গ্রামের জেলে ফুল মিয়া জানান, সুন্দরবনে মাছ ধরতে না পেরে তার পরিবার খুবই কষ্টে রয়েছে। ২৫ বছর ধরে সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের কষ্টের শেষ নেই। সরকারের কাছে বিকল্প কর্মসংস্থানের দাবি জানান ওই জেলে।