সকল জল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মেজর সকার লিগের ক্লাব ইন্টার মায়ামিকে (এমএলএস) বেছে নিলেন লিওনেল মেসি। বুধবার মেসি মায়ামি ফ্র্যাঞ্চাইজিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন, যেটির নেতৃত্বে রয়েছেন আরেক বিশ্ব ফুটবল আইকন ডেভিড বেকহ্যাম।
দুটি স্প্যানিশ নিউজ আউটলেট মুন্দো দিপোর্তিভো ও দিয়ারিও স্পোর্ত-এর সঙ্গে সাক্ষাত্কারে আর্জেন্টাইন গ্রেট তার সিদ্ধান্ত প্রকাশের কিছুক্ষণ আগে ইন্টার মায়ামির মালিক জর্জ মাস মেসির জার্সির একটি ছবি টুইট করেন।
সবাই ধারণা করছিল, তার দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসেরে যোগ দেওয়ার পর এবার মেসিও আরেক সৌদি ক্লাব আল-হিলালে যোগ দেবেন।
আরেকটি সম্ভাবনা ছিল বার্সেলোনায় ফিরে যাওয়ার, যেখানে তিনি তার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেসির এমএলএসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সবাইকে অবাক করেছে।
তিনি বুধবার এক সাক্ষাত্কারে বলেন, কিছু চূড়ান্ত বিষয়ে এখনও আলোচনা করা দরকার, তবে তিনি মায়ামিতে ‘তার যাত্রা চালিয়ে যাওয়ার’ প্রত্যয় জানিয়েছেন।
মেসি বলেন, ‘বিশ্বকাপ জেতার পর এবং বার্সেলোনায় ফিরতে না পারায়, ফুটবলকে নিয়ে অন্যভাবে বাঁচার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের লিগে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত।’
তিনি টাকা বা স্মৃতিকে বেছে নেননি, বরং নতুন এক অভিজ্ঞতার খোঁজে তিনি মায়ামিকে বেছে নিয়েছেন।
জানা গেছে, মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে আগামী ১৫ জুন বেইজিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এবং এর চারদিন পরে জাকার্তায় ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে খেলবেন।
তারপরে আগামী জুলাই মাসে ইন্টার মায়ামিতে তার অভিষেক হবে।
এমএলএসের একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘আমরা আনন্দিত লিওনেল মেসি জানিয়েছেন যে তিনি এই গ্রীষ্মে ইন্টার মায়ামি এবং মেজর লিগ সকারে যোগ দিতে চান।’
আরও পড়ুন: আল-হিলালে লিওনেল মেসি, সত্যি না-কি কেবলই গুঞ্জন?
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘যদিও একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি চূড়ান্ত করার জন্য আরও কিছু কাজ বাকি আছে, তবে আমরা আমাদের লিগে সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজনকে স্বাগত জানাতে উন্মুখ।’
সাতবারের ব্যালন ডি’অর বিজয়ী ৩৫ বছর বয়সী মেসির নিজেকে প্রমাণ করার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। গত ডিসেম্বরে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দিয়ে তিনি তার মুকুটে সর্বশেষ পালক যোগ করেছেন।
ক্লাব ও দেশের হয়ে ক্যারিয়ারে মেসির ৮০০ টিরও বেশি গোল রয়েছে, যা তার নামকে ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা খেলোয়ার হিসেবে অবিস্মরণীয় করেছে।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে আর্জেন্টিনার প্রতিনিধিত্ব করার ১৭ বছরেরও বেশি সময়ে তিনি ৩৮টি ভিন্ন জাতীয় দলের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ১০২টি গোল করেছেন। এই গোলগুলোর মধ্যে ১৬টি মার্কিন মাটিতে করা।
ফ্রান্সের বিপক্ষে গত বছরের বিশ্বকাপ ফাইনালে তিনি দুবার গোল করেছিলেন। নির্ধারিত ৯০ মিনিট ও তার পর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলায় তিনি ২ গোল করেন এবং ম্যাচটি ৩-৩ ব্যবধানে শেষ হয়। পরবর্তীতে পেনাল্টিতে ১ গোল করেন এবং আর্জেন্টিনা ৪-২ ব্যবধানে জয়লাভ করে।
এছাড়াও তিনি চারবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ বিজয়ী এবং শীর্ষ ক্লাব প্রতিযোগিতায় ১৪০ গোল দেওয়া রোনালদোর পরেই ১২৯ গোল দেওয়া মেসির অবস্থান। মেসি ১০টি লা লিগা শিরোপা এবং দুটি লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, সাতটি কোপা দেল রে, তিনটি ক্লাব বিশ্বকাপ, একটি কোপা আমেরিকা এবং আর্জেন্টিনার হয়ে অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিতেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খেলার মেসির সিদ্ধান্ত প্রো মঞ্চে আমেরিকান ফুটবলের জন্য সবচেয়ে বড় ইতিহাস হতে পারে। যদিও পেলে, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, থিয়েরি হেনরি ও বেকহ্যাম নিজে তাদের কেরিয়ারের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন।
মার্কিন জাতীয় দলের নিয়মিত ন্যাশভিল ডিফেন্ডার ওয়াকার জিমারম্যান বলেছেন, ‘আমি মনে করি এটি (মেসিকে আনা) এই দেশের খেলাধুলার জন্য দুর্দান্ত হবে, বিশেষ করে ২০২৬ বিশ্বকাপের আগে। এবং আমি তার বিপক্ষে খেলতে আগ্রহী।’
আরও পড়ুন: ফিফার বর্ষসেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসি
মেসিকে মায়ামির পক্ষে আনতে মায়ামির মালিকানাধীন এমএলএস, অ্যাডিডাস ও অ্যাপলের মধ্যে বোঝাপড়া করতে কয়েক মাস সময় লেগেছে।
এমএলএস-এর একটি সম্প্রচার অংশীদার অ্যাপল গত মঙ্গলবার ঘোষণা করেছে যে তারা একটি চার পর্বের ডকুমেন্টারি সিরিজে ‘বিশ্বের সুপারস্টার লিওনেল মেসির কিছু এক্সক্লুসিভ বিহাইন্ড দ্য সিন দেখাবে। এতে তার নিজের জবানিতে মেসি আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের সঙ্গে তার অবিশ্বাস্য ক্যারিয়ারের গল্প এবং বিশ্বকাপ জয়ের জন্য তার সংগ্রাম প্রভৃতি বিষয় উঠে আসবে এবং এখন তার গল্পে মিয়ামি অধ্যায়ও থাকবে।’
মেসি এমন একটি দলে যোগ দিচ্ছেন, যেটির প্রথম ম্যাচটি খেলার জন্য ছয় বছর সময় লেগেছিল এবং এর প্রথম চারটি মৌসুমে উল্লেখযোগ্য কোনো অর্জন নেই।
ইন্টার মায়ামি সর্বশেষ ইস্টার্ন কনফারেন্সে বসেছিল এবং সদ্যই তার কোচকে বরখাস্ত করেছে। এটি তার প্রথম তিন মৌসুমের মধ্যে দুটিতে প্লে-অফ করেছে কিন্তু জয়ের রেকর্ড বা এমনকি একটি ইতিবাচক গোলের পার্থক্য নিয়েও একটি মৌসুম শেষ করতে পারেনি।
তবুও, কয়েক মাস ধরে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে মেসির গন্তব্যের তালিকায় মায়ামি রয়েছে। মেসি এই বসন্তে ইন্টার মায়ামির সহ-মালিক বেকহ্যামের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছিলেন।
অন্যদিকে, বার্সেলোনা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে এই খেলোয়াড়ের বাবা হোর্হে মেসি তার মায়ামিতে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা ক্লাব সভাপতি জোয়ান লাপোর্তাকে জানিয়েছেন এবং তার মঙ্গল কামনা করেছেন।
বার্সেলোনার বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘প্রেসিডেন্ট লাপোর্তা স্পটলাইট এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে চাপের শিকার হচ্ছেন তার থেকে দূরে, কম চাপের একটি লিগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মেসির এই সিদ্ধান্তকে বুঝতে পেরেছেন এবং সম্মান করছেন।’
বার্সেলোনা মেসিকে সুপারস্টার বানিয়েছিল, কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে দুই বছর আগে তিনি ক্লাব ছাড়তে বাধ্য হন।
বুধবার মেসি বলেন, ‘আমি শুনেছি যে তাদের খেলোয়াড় বিক্রি করতে হবে বা খেলোয়াড়দের বেতন কমাতে হবে। সত্যি বলতে আমি এর মধ্য দিয়ে যেতে চাইনি।’
সৌদি আরবের সঙ্গে কোনো আর্থিক সমস্যা নেই, এবং মেসি যখন তার তৎকালীন ক্লাব পিএসজির অনুমতি ছাড়া সৌদিতে ঘুরতে যান, তখন তার সেখানে থেকে যাওয়ার জল্পনা আরও তীব্র হয়। পিএসজি তাকে সাসপেন্ড করে এবং কিছু ভক্ত তার দিকে আঙুল তোলে। তখন থেকেই সবাই জানত যে তিনি আর পিএসজিতে ফিরবেন না।
তবে খুব কম মানুষই ভেবেছিলেন যে তিনি মায়ামিতে যোগ দিতে পারেন।
আরও পড়ুন: জুনে ঢাকা সফরে আসছে মেসিরা