খাদ্যের ঘাটতি ‘মানবসৃষ্ট’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘বাস্তব অর্থে, পৃথিবীতে খাদ্যের কোন অভাব নেই। অভাবটি শুধু মনুষ্যসৃষ্ট। অস্ত্র তৈরিতে বিনিয়োগ করা অর্থের একটি ভগ্নাংশও যদি খাদ্য উৎপাদন এবং বিতরণে ব্যয় করা হয় তবে এই পৃথিবীতে কেউ ক্ষুধার্ত থাকবে না।’
সোমবার জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরাম ২০২২-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে এই অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দেন।
শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, খাদ্য নিয়ে রাজনীতি এবং ব্যবসায়িক স্বার্থ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, কীটপতঙ্গ ও রোগ সবই কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, হিসেব অনুযায়ী ৮০ কোটিরও বেশি মানুষ বা বিশ্ব জনসংখ্যার ১০ শতাংশ নিয়মিত ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমায়।
তিনি বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং পরবর্তী নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হয়েছে। যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত করেছে এবং খাদ্যের জন্য খরচ বেড়েছে।’
তিনি উল্লেখ করেছেন যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য অবদানের ফলে প্রচুর সম্পদ রয়েছে এমন একটি বিশ্বে, এটি (খাদ্য ঘাটতি) খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যুদ্ধ বন্ধ করতে, খাদ্য নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করতে এবং খাদ্যের অপচয় বন্ধ করার অনুরোধ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এর পরিবর্তে অনুগ্রহ করে এমন এলাকায় খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করুন, যেখানে অভাব ও দুর্ভিক্ষ রয়েছে। মানুষ হিসেবে, আমাদের অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে প্রত্যেকেরই খাবার খেয়ে এবং একটি নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে।’
বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তিনি যে সব কৃষি কর্মসূচি ও অন্যান্য উন্নয়ন উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর, কয়েক দশক এ ধারা অব্যাহত ছিল।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন এবং অবিলম্বে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য, বিশেষ করে কৃষিতে ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা শুরু করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন চার মিলিয়ন মেট্রিক টন চালের ঘাটতি ছিল এবং যখন তিনি তার প্রথম মেয়াদ শেষ করেন তখন ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন চালের উদ্বৃত্ত ছিল।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বর্তমান মেয়াদে আমরা আবারও ধান উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছি। মোট ধান উৎপাদন ২০০৮ সালে ২৮ দশমিক ৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন থেকে গত বছর ৩৮ মিলিয়ন মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। এটি আমাদের বাস্তবসম্মত নীতিমালা, প্রচুর প্রণোদনা এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের কঠোর পরিশ্রমী কৃষকদের কারণে সম্ভব হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, সরকারের নীতিমালায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যান্ত্রিকীকরণ ও নতুন প্রযুক্তি অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে এবং কৃষকদের ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি হারে কৃষি উপকরণ প্রদান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তাদের ৭১ হাজারেরও বেশি কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। ‘আমরা ২০২৫ সালের মধ্যে আরও ৫১ হাজারের বেশি যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা করেছি।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, তার দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকা দুই কোটি কৃষককে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দেয়া হয়েছে।
এই কার্ডধারীদের সরাসরি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ফসল উৎপাদনের জন্য ঋণ দেয়া হয় এবং কৃষি উপকরণের জন্য ভর্তুকি দেয়া হয়। এছাড়াও, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষিতে বিনিয়োগের জন্য একটি কৃষি ও গ্রামীণ ঋণ নীতি গ্রহণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০২০-২০২১ সময়ের মধ্যে ২ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ঋণ দেয়া হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, এত কিছুর পরও বাংলাদেশের কৃষি খাত জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ এবং, জলবায়ু পরিবর্তন টেকসই কৃষির জন্য একটি বড় হুমকি। তবুও, বাংলাদেশ এবং তার সহনশীল জনগণ জীবনের সর্বক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য অক্লান্তভাবে এগিয়ে চলেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষি পণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশ শাকসবজি, মাছ ও অন্যান্য কৃষিভিত্তিক পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সফল হয়েছে, যার অনেকটাই রপ্তানি হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ পাট ও মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান ও সবজিতে তৃতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ এবং ইলিশ মাছ উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে প্রথম।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে আগামীকালের বিনিয়োগ ফোরামে বাংলাদেশ প্রদর্শিত ২০টি দেশের মধ্যে একটি হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের জন্য মূল্য শৃঙ্খলসহ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের আকর্ষণীয় সুযোগ উপস্থাপন করব। আমরা আমাদের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার দিকেও ফোকাস করব এবং অন্যান্য ব্যবসার সুযোগ তুলে ধরব।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। বাংলাদেশে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কৃষি খাতে বিনিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে চাই।’