নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোকে একটি বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মসৃণ যাত্রা নিশ্চিত করতে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন।
তারা বলেন, রাজনৈতিক সংকট ও তাদের মধ্যে আস্থার অভাব দূর করতে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকরী করতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত, বিশ্বের অন্য কোনো দেশ বা রাজপথের আন্দোলন; কোনোটাই বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন করতে সাহায্য করতে পারে না।
শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে নতুন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ফর গ্লোবাল অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ (এসজিবিএস) এবং এক্সপার্টস একাডেমি লিমিটেড-এর যৌথভাবে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ:পাথওয়ে টু ডেমোক্রেসি অ্যাডভান্সমেন্ট’- শীর্ষক সেমিনারের বক্তারা এসব কথা বলেন।
ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশের (ইউএনবি) সম্পাদক ও এসজিবিএস-এর চেয়ারম্যান ফরিদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এসজিবিএসের নির্বাহী পরিচালক মিথিলা ফারজানা।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) ব্যুরো চিফ জুলহাস আলম।
সেমিনারে স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ভোটের ক্ষেত্রে জনসমর্থনের পার্থক্য বেশি না। ‘সুতরাং, এক দল অন্য দলকে নির্মূল করতে পারবে না। এটা সম্ভব না... তাই দুই দলকে আলোচনা ও ঐকমত্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
তিনি বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংকট কাটিয়ে ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীনদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হুসাইন বলেন, দেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে না।
তিনি বলেন, ‘আমরা বাইরের দেশের হস্তক্ষেপের কথা বলছি। কিন্তু এর পেছনের কারণ কী? আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি আস্থা নেই। এই পরিস্থিতিতে যদি আমরা গণতন্ত্র ফিরে পেতে চাই, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করার পদক্ষেপ নিতে হবে।’
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) এম আব্দুর রশীদ বলেন, কিছু দল বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করে আগামী নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করছে। ‘আমরা আমাদের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব অন্যদের দিয়ে দিচ্ছি। এটা গণতন্ত্র হতে পারে না।’
তিনি বলেন, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কোনো ধরনের হুমকি-ধামকি ছাড়া সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন। ‘যদি কোনো দল ওয়াকওভার দেয়, তাহলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না। তাই বাংলাদেশে সুস্থ গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন শুধু একদিনের বিষয় নয়, কারণ একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে এর সঙ্গে অনেকগুলো ধাপ ও প্রক্রিয়া জড়িত।
তিনি বলেন, ‘কিছু প্রতিষ্ঠান পদক্ষেপ নেবে ও প্রক্রিয়াগুলো সম্পাদন করবে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কি হবে না, প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা তা নির্ধারণ করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি আমরা সঠিক ও সুস্থ রাজনীতির চর্চা না করি এবং আলোচনায় না বসি, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না। আমি বলতে পারি, রাজপথে থেকে সমাধান আসবে না। তাই, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খোলা মন নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। শুধুমাত্র রাজনীতিবিদরাই টেকসই গণতন্ত্রের পথ খুঁজে বের করতে পারেন।’
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, গণতন্ত্র নিয়ে সংকট দেশে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে বাধা সৃষ্টি করেছে। ‘রাজনৈতিক দলগুলো এর জন্য দায়ী। রাজনীতিবিদরা কি বলতে পারেন তারা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্বে বা বর্তমানে স্বাধীনভাবে কাজ করতে অনুমতি দিয়েছেন? এটাই বর্তমান সংকটের মূল কারণ।’
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় ধরে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে রাজনীতিবিদরা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।
সোহরাব বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে এখন দেশের স্বার্থে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি বলেছেন, রাজনীতিবিদরা এখনো গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে পারেননি। ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে। আর এখন আওয়ামী লীগ বলছে দেশে গণতন্ত্র আছে, আর বিএনপি বলছে গণতন্ত্র নেই।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, রাজনীতিবিদদের হাতে এখন কিছুই নেই। কারণ রাজনীতিবিদরা সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও পেশাজীবী সংস্থাকে ধ্বংস করার কারণে দেশ এখন আমলাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেছেন, গণতন্ত্র ও নির্বাচন সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানের জন্য প্রকৃত ও খোলা মন এবং সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সংলাপ প্রয়োজন। ‘অতীত ঘটনা ও সমস্যার পেছনের কারণগুলো পর্যালোচনা করে প্রকৃত সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘শুধু আগামী নির্বাচনের জন্য নয়, ভবিষ্যতের জন্যও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের একটি শক্তিশালী ও প্রকৃত ভিত্তি প্রয়োজন।’
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল, মান্নান, এক্সপার্টস একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা হাসান রহমান, আমাদের নতুন সময় পত্রিকার সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান, ক্ষমতাসীন দলের এমপি নাহিম রাজ্জাক, ফেমার সভাপতি মুনিরা খান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক সাদেকা হালিম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলে ফাহিম, এক্সপার্ট একাডেমির উপদেষ্টা সিরাজুল ইসলাম এবং আর্টিকেল ১৯ এর আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সেল প্রমুখ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।