শনিবার কোস্ট ট্রাস্ট ও স্থায়িত্বশীল গ্রামীণ জীবন-জীবিকার জন্য প্রচারাভিযান (সিএসআরএল) আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সেমিনারে তারা এ সুপারিশ করেন।
পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমদের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী।
কোস্ট ট্রাস্টের রেজাউল করিম চৌধুরী এবং সিএসআরএলের জিয়াউল হক মুক্তার সঞ্চালনায় সেমিনারে অনলাইনে সংযুক্ত ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. তালুকদার আবদুল খালেক, সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক (কক্সবাজার-২), নুরুন্নবী চৌধুরী (ভোলা-৩), মো. মনোয়ার হোসেন চৌধুরী (গাইবান্ধা-৪), ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু (বরগুনা-২) ও ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী (গাইবান্ধা-১)।
এছাড়া, কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, খুলনা, রংপুর, ভোলা ও গাইবান্ধা জেলা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান সেমিনারে যোগ দেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় কোস্ট ট্রাস্টের আরিফ দেওয়ান উল্লেখ করেন, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এবং দীর্ঘ মেয়াদি বন্যায় সারা দেশে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭,৫০০ কোটি টাকা। ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয় রোধে আসন্ন শুকনো মৌসুমে বেড়িবাঁধগুলোর জরুরি মেরামতের প্রয়োজন। প্রতিবছর জাতীয় বাজেটের মাত্র ৩ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা গেলে পাঁচ বছরের জলবায়ু পরিবর্তন সহনীয় বাঁধ নির্মাণের খরচ মেটানো সম্ভব।
তিনি বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তুলে ধরেন। সেগুলো হলো: আসন্ন শুকনো মৌসুমে বাঁধ নির্মাণের জন্য জরুরি বরাদ্দ হিসেবে কমপক্ষে ১২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা উচিত, দীর্ঘ মেয়াদি বাঁধ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে, তথাকথিত উপ-ঠিকাদারি ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।
কাজী খলিকুজ্জামান আহমদ বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা আছে, কিন্তু অগ্রাধিকারগুলো চিহ্নিত করা হয়নি। অন্যান্য উন্নয়নের বিষয়গুলোর পাশাপাশি বাঁধ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসার জন্য আমাদের সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি প্রয়োজন। এটি একটি কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে এবং এতে সমাধানগুলো স্থায়িত্বশীল হতে পারে।’
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘টেকসই বাঁধ ও নদী ব্যবস্থাপনার নীতিমালা না থাকায় প্রতিবছর বাঁধ মেরামত ও নির্মাণের নামে বিশাল আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের একটি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন এবং পানি ও নদী ব্যবস্থাপনার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বিতভাবে কাজ করার উপায় আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।’
জিয়াউল হক মুক্তা বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিপদাপন্ন অঞ্চল এবং জেলাগুলোতে পদায়ন করতে হবে। নদীভাঙন ও বাঁধ ভাঙার ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ আবশ্যক। শুকনো মৌসুমেই মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজগুলো বাস্তবায়ন করে ফেলতে হবে।’
রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘সরকারকে নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পৃথকভাবে জাতীয় বরাদ্দ ঘোষণা করতে হবে। যাতে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে হতে পারে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে থাকবে নির্মাণের জন্য বরাদ্দ অর্থ। এতে করে সময়মতো বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমবে।’
তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, ‘মূলত নদীতে পলী জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ এ জলাবদ্ধতাকে বাড়িয়ে তুলছে। দীর্ঘ মেয়াদি সমাধানের জন্য সরকারকে এ দুটি বিষয়কেই বিবেচনায় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ সুফল নিশ্চিত করতে হলে স্থানীয় সরকারের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে।’
ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি আসন্ন শুকনো মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো মেরামত করার জন্য বিশেষ আপদকালীন তহবিল সৃষ্টিরও সুপারিশ করেন।
মনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে পলিবাহিত নদীগুলো ভাঙনের শিকার হচ্ছে, বাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বন্যায় বিপুল সংখ্যক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনগণ এবং সম্পদ বাঁচাতে নদী খননের বিষয়ে পরিকল্পিত পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যারিস্টার শামীম পাটোয়ারী বলেন, নদীভাঙন এবং দারিদ্র্যের কারণে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রতি বছর প্রায় ৫,০০০-৫০,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। বর্তমান জাতীয় বাজেট অপ্রতুল। দীর্ঘ মেয়াদের ভিত্তিতে বাঁধ রক্ষা ও নদীভাঙন রোধের জন্য বিদেশি সহায়তাও বাড়ানো প্রয়োজন।
আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপযুক্ত নকশা ও যথাযথ নির্মাণের অভাবে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় এলাকায়, বিশেষ করে কক্সবাজার জেলায় জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে না, মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাটির ধরন এবং উপকূলীয় অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে উপযুক্ত বাঁধের নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণ করতে হবে।
নুরুন্নবী চৌধুরী বলেন, বঙ্গোপসাগরের মুখে অবস্থিত ভোলা জেলাকে বাঁচাতে নদীভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর ও টেকসই বাঁধের নকশা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।