ব্রহ্মপুত্র নদে নির্মাণাধীন কেওয়াটখালী আর্চ স্টিল ব্রিজ প্রকল্পে একনেক অনুমোদিত মূল নকশা উপেক্ষা করে বিপুল অর্থ, পরিবেশ ও জনজীবনের ক্ষতি করে যে নকশাবহির্ভূত সংযোগ সড়ক নির্মাণের চেষ্টা চলছে, তা অবিলম্বে বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে।
রবিবার (১৩ জুলাই) বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে ‘সদাজাগ্রত ময়মনসিংহ’ ব্যানারে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এই দাবির কথা বলা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সদাজাগ্রত ময়মনসিংহ-এর প্রধান সংগঠক ও ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আবুল কালাম আল আজাদ। তিনি বলেন, ‘ময়মনসিংহ নগরী বর্তমানে পৃথিবীর নবম ধীরগতির শহর। এর অন্যতম কারণ শম্ভুগঞ্জ চায়না সেতুর নাজুক যানজট পরিস্থিতি। জনদুর্ভোগ নিরসনে ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট একনেক অনুমোদিত নকশায় কেওয়াটখালী এলাকায় একটি সড়ক সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার কাজ ২০২৫ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এখনও মূল নকশা অনুযায়ী কাজ শুরুই হয়নি।’
তিনি জানান, ‘মূল নকশার বাইরে বর্তমানে ২ হাজার ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি বাঁকানো ‘ইউ’ আকৃতির র্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে, যা গিয়ে মিশছে পুরনো চায়না সেতুর সংযোগ সড়কে। এতে দুটি সেতুর সংযোগ সড়ক এক হয়ে যাচ্ছে, যা ভয়াবহ যানজট ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করছে।’
এই র্যাম্প তৈরির জন্য ইতোমধ্যে ৩২ একর নতুন ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এতে একটি খাল, সাতটি জলাশয়, কৃষিজমি, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদ্রাসা, ৬৫টি কবরস্থান ও বহু বসতভিটা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ হচ্ছে।
এছাড়া গড়ে তোলা হচ্ছে ৩০ ফুট উঁচু ২ কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ক ও একাধিক ওভারপাস, যার জন্য অতিরিক্ত ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বক্তারা বলেন, এই অর্থ দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে আরও দুটি সেতু নির্মাণ সম্ভব।
তারা অভিযোগ করেন, প্রকল্পটিকে জনগণের স্বপ্ন থেকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দুঃস্বপ্নে পরিণত করা হচ্ছে। মূল পরিকল্পনার বাইরে এই নির্মাণকাজ কিছু প্রভাবশালী আবাসন ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজদের স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে, যারা প্রকল্প এলাকার জমির মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছে।
বক্তারা জানান, এই অনিয়মের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ, নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন সংগঠন বহুবার প্রশাসনের কাছে আবেদন, স্মারকলিপি ও মানববন্ধন করলেও প্রশাসন কার্যত নিরব থেকেছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও, ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি সরেজমিন তদন্ত শেষে আজ পর্যন্ত তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। বরং অভিযোগকারীদের হুমকি, হামলা ও মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে।
সবশেষে বক্তারা বলেন, “আবুল কালাম আল আজাদ বনাম বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য” শীর্ষক মামলায় হাইকোর্ট ৪ জুন রুল জারি করেছেন এবং প্রশ্ন তুলেছেন—কেন একনেক অনুমোদিত মূল নকশা অনুসরণ না করে নকশা বহির্ভূত কাজ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হবে না? এই রুলের আলোকে তারা দ্রুত নকশা বহির্ভূত কাজ বন্ধ এবং একনেক অনুমোদিত পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার আহ্বান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব, প্রাণ–প্রকৃতি–পরিবেশ প্রতিবেশ রক্ষা জাতীয় কমিটির মুখপাত্র ইবনুল সাঈদ রানা, হাওড় অঞ্চলবাসীর সমন্বয়ক ড. হালিম দাদ খান, তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক সৈয়দা রত্না, সদাজাগ্রত ময়মনসিংহের সমন্বয়ক মজিবুর রহমান মিন্টু প্রমুখ।
বক্তাদের মূল দাবি:
• একনেক অনুমোদিত মূল নকশার বাইরে সব নির্মাণ কাজ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে
• কেওয়াটখালী আর্চ স্টিল ব্রিজের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে
• দুই সেতুর সংযোগ সড়ক যেন আলাদা থাকে, সে অনুযায়ী পুনর্গঠন করতে হবে
• পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে রাস্তা ও র্যাম্প নির্মাণ থেকে বিরত থাকতে হবে
• তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ ও দুর্নীতিবাজদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে