প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ১৯৮০ সালের পর প্রবৃদ্ধির এত বড় পতন আর দেখা যায়নি। ১৯৯২ সালের পর এ প্রথম দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০-২১ সালের বাজেট গতানুগতিকতার বাইরে এসে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে গণরাষ্ট্রের ভিত রচনা করার জন্য কার্যকর দিক-নির্দেশনা রাখতে পারেনি। সার্বজনীন প্রাথমিক প্রয়োজন নিশ্চিতকরণে পর্যাপ্ত উদ্যোগ প্রতীয়মান হয়নি। ম্রীয়মান দেশীয় অর্থনীতি করোনাকালীন পরিস্থিতিতে ঘনীভূত সংকটে পতিত হয়েছে বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি।
তারা বলছে, শাটডাউনের কারণে বিভিন্ন উৎপাদনশীল খাতে লোকসানের ফলে আয় কমে গিয়ে দেশ একটি ‘নতুন’ দরিদ্রতার উত্থানের দিকে যাবে।
প্রতিষ্ঠনটির গবেষণা অনুসারে, লকডাউনের কারণে আয় কমে যাওয়ায় বা বন্ধ থাকায় ৪৩.৫ শতাংশ পরিবার আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার চেয়ে কম আয় করবে। সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী পরিস্থিতিতে ৪৭.৪৩ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থা করবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পদ্ধতিগতভাবে অর্থনীতি পুনরায় সচল করতে পারলে দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা ৩৯.৪৩ শতাংশে নেমে আসবে বলেও তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
উন্নয়ন অন্বেষণ বলছে, বাংলাদেশে ১৯৯২ সালের পর এ প্রথম দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এ সংকোচন অর্থনীতির গতানুগতিক কারণ তথা চাহিদা ও যোগানের হ্রাসের কারণে ঘটছে না। বরং করোনা মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী সরকার কর্তৃক সকল প্রকার অর্থনৈতিক কার্যাবলী বন্ধের ফলে অর্থনীতি এ মন্দায় পতিত হয়েছে। ১৯৮০ সালের পর প্রবৃদ্ধির এত বড় পতন আর দেখা যায়নি। বেকারত্বের হার ২০১৮ সাল থেকে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে যা ১৯৮৪ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
বিপুল সংখ্যক প্রবাসী দেশে ফেরত আসলে দারিদ্র্য পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যেতে পারে উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়া এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গিনি সহগ শূন্য দশমিক ৩২ থেকে বেড়ে শূন্য দশমিক ৫০ এবং পা’মা রেশিও ২ দশমিক ৯৩ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে, জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে ১ শতাংশ হ্রাসে বেকারত্বের শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটবে। সুতরাং, জিডিপি হ্রাসের কারণে বেকারত্বের হার ৩ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে। যার ফলে মানুষের আয় কমে যাবে।
প্রবৃদ্ধি, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ
উন্নয়ন অন্বেষণের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রস্তাবিত ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অবাস্তব।
এ বছর মোট দেশজ উৎপাদনের উচ্চ প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের চেয়ে চলমান সংকট থেকে অর্থনীতির পুনর্বাসন, পুনরুদ্ধার ও পুনর্নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়াই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রত্যাশিত, বলছে তারা।
মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিকাঠামো ও বাজেট
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে প্রকৃত পরিবর্তনের পরিমাণ ৭ দশমিক ৮ শতাংশ যা জিডিপির শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ এবং বাজেটের ৫.১ শতাংশ। এছাড়া শিক্ষা ও প্রযুক্তির ২.৪ শতাংশ এবং সামাজিক সুরক্ষা বাজেটে ২.৫ শতাংশ পরিবর্তন থাকলেও জনসেবামূলক খাতে বরাদ্দ অপর্যাপ্তই রয়ে গেছে। উন্নয়ন অন্বেষণ মনে করে, স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অন্তত ৫-৬ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে।
পূর্ববর্তী বছরের মূল্যস্ফীতি সমন্বিত বরাদ্দের তুলনায় এ বছর সামাজিক সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ ৭৯০ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু এটি করোনার কারণে সৃষ্ট বিপুল সংখ্যক নতুন দারিদ্র্য এবং বেকারদের জন্য যথেষ্ট নয়। শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে কেবলমাত্র ৩৯৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এসএমই এবং উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা খুব বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
কৃষি
গত ছয় বছরে কৃষিতে ভর্তুকি ৯,০০০ কোটি টাকার মধ্যে আটকে আছে, যার অর্থ বাজেটের আকার বাড়ার সাথে সাথে প্রতি বছর অনুদানের অনুপাত হ্রাস পাচ্ছে। কৃষিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকির ঘাটতি রয়েছে। এ অর্থবছরে সরকার ভর্তুকিতে ৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়েছে তবে বিশ্বব্যাপী মহামারির মুখে এ বৃদ্ধি স্থিতিশীল খাদ্য সুরক্ষা তৈরি করতে যথেষ্ট নয়।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, কৃষি খাতে পর্যাপ্ত মনোযোগ না দেয়া হলে আগামী দিনে খাদ্য সুরক্ষা মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়বে। করোনাকালেও কৃষিতে বাজেটের মাত্রা জিডিপির ০.৯ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল আশা করা সম্ভব নয়।
শিল্প
উৎপাদন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে পড়ায় পুরো সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবার জন্য বরাদ্দ ৩৯৪০ কোটি টাকা যা গেল অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয়ের পর ৪১০১ কোটি থাকা থেকে কিছু কম। এ বরাদ্দ হ্রাসে মহামারি মোকাবিলা করে উৎপাদনশীল খাতের পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠন কঠিন হয়ে যাবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগ বন্ধ হয়েছে। প্রায় ২৮ শতাংশের আয় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ব্যাংকগুলোর আরোপিত কঠিন শর্তের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি স্তরের উদ্যোক্তারা ঋণে সহজ প্রবেশাধিকার পাচ্ছেন না। নারী উদ্যোক্তারা এসএমই খাতের সমস্ত ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ পাওয়ার কথা। এবারের বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে।
সেবা খাত
সেবা খাত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্ধ হয়ে গেছে। নির্মাণ শিল্প, পরিবহন, পর্যটন, হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদির কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। মহামারির কারণে এ খাতে প্রায় ৫৭০০ কোটি টাকা লোকসানের অনুমান করা হয়েছে। লকডাউনের কারণে পরিবহন খাতে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
সার্বজনীন প্রাথমিক প্রয়োজন
করোনার কারণে স্বাস্থ্য খাতে নতুন চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশায় সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগী কেউই সেবা পাচ্ছে না। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ একেবারে সামান্য বেড়ে গতবারের বাজেটের ৪.৯ থেকে এবার ৫.১ শতাংশ হয়েছে।
শিক্ষা ও প্রযুক্তিখাতে ৮৫৭৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে যা বাজেটের ১৫.১ শতাংশ। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে জিডিপির ২.৭ শতাংশ বরাদ্দ আছে। কিন্তু শিক্ষা বৃদ্ধি, গবেষণা, নাগরিকত্ব বোধ সৃষ্টিতে ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী অন্তত জিডিপির ৬ শতাংশের কাছাকাছি বরাদ্দ রাখার দরকার রয়েছে।
সামাজিক সুরক্ষা নেট খাতে বাজেটের বরাদ্দ বেড়ে ৯৫৫৭৪ কোটি টাকা হয়েছে যা জিডিপির ৩.০১ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত কর্মসূচিগুলো সার্বজনীন নয়। নতুন সৃষ্টি হওয়া দারিদ্র্যকে টেনে ধরতে এ বরাদ্দ সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।