পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। শুধু একটা বাড়ি নয়, তিনটি বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয়েছিল। এমনকি শিশু শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। এরকম নির্মম হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর অন্যকোন দেশে ঘটেছে বলে জানা নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা পৃথিবীতে এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখতে চাই না। আজকে আমাদের প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত- আমরা এমন এক পৃথিবী গড়ে তুলবো যেখানে শেখ রাসেলের মতো যেন আর কোন শিশুকে জীবন দিতে না হয়।’
শেখ রাসেল দিবস - ২০২২ উদযাপন উপলক্ষে মঙ্গলবার বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, পৃথিবীতে যত শিশু আছে, সব শিশুর অধিকার, তাদের জীবনের অধিকার, তাদের বয়সে যেসব অধিকার পাওয়ার কথা সেগুলো নিশ্চিত করা এবং সেই পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি বলেন, এমন পৃথিবী আমরা রেখে যেতে চাই যেখানে শিশুরা নিঃসঙ্কোচে জীবন যাপন করতে পারবে।
ড. মোমেন বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে যেভাবে সারা পৃথিবীতে একটি যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে শিশুদের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী আমরা রেখে যেতে পারবো কিনা তাতে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোর মূলে রয়েছে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে হিংসা, বিদ্বেষ আর ক্ষমতার লড়াই।’
তিনি বলেন, ‘যে সমস্ত ইস্যু আমাদের বিশ্বকে দ্বিধাবিভক্ত করছে, মানুষের জীবনকে অস্থির করে তুলছে এগুলো কমাতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ একটি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে- সেটা হলো, ‘কালচার অব পিস’ বা শান্তির সংস্কৃতি। এর মূল কথা হচ্ছে- আমাদের মধ্যে সহিষ্ণুতার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অন্যের প্রতি সম্মান দেখানোর মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে। এটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে একটা শান্তিপূর্ণ স্থিতিশীল বিশ্ব গড়ে তুলতে পারবো। শেখ রাসেল দিবসে আমাদের এই মনোভাব গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে। আর এটা শুধু সরকারের একার দায়িত্ব নয়। এজন্য সব শ্রেণি পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের নাম বৃটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে রেখেছিলেন। বিশ্বশান্তি রক্ষায় সোচ্চার, শান্তির সংগ্রামী বার্ট্রান্ড রাসেলের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে পুত্রের নাম রেখে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকার স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে বলেন, ‘১৯৭৫ সালের পনের আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেট কেড়ে নিল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র, মাত্র এগারো বছরের ছোট্ট রাসেলকে। মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল রাসেলকে। ওই ছোট্ট বুকটা কি তখন ব্যথায় কষ্টে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাদের সান্নিধ্যে স্নেহ-আদরে হেসে খেলে বড় হয়েছে তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে ওর মনের কী অবস্থা হয়েছিল- কী কষ্টই না ও পেয়েছিল! কেন, কেন, কেন আমার রাসেলকে এত কষ্ট দিয়ে কেড়ে নিল? আমি কি কোনোদিন এই ‘কেন’র উত্তর পাব?’
শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যার এই আকুতিভরা প্রশ্নের জবাব কে দিবে? কেউ দিতে পারেনি। হয়তো কেউ দিতেও পারবেনা।’
স্বাগত বক্তব্যে পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘শেখ রাসেল জন্মের পরে ছয় বছর পর্যন্ত পিতার আদর, ভালবাসা, স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন যে শিশুটি তাকেই কি না ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারাতে হল।’
তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেনি।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, শহিদ শেখ রাসেল হতে পারেন আগামী দিনের শিশুদের প্রেরণা। জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতির পুত্র হয়েও যে সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে তার পথচলা শুরু হয়েছিল, সাধারণ মানের স্কুল, সাদামাটা জীবন যাপন, আর দশটা সন্তানের মতই রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ানো এবং পারিবারিক শিষ্টাচার ও আদব কায়দার যে উদাহরণ তিনি রেখে গেছেন তা আগামী দিনের শিশুদের চলার পথের বিরাট এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।’
‘শেখ রাসেল নির্মলতার প্রতীক দুরন্ত প্রাণবন্ত নির্ভীক’ প্রতিপাদ্যে শেখ রাসেল দিবসের এই আলোচনা অনুষ্ঠানে সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেখ রাসেলের সহপাঠী সাবেক ব্যাংকার ও এম এ মতিন কটন মিলের মহাব্যবস্থাপক মো. হাফিজুল হক এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস।
শেখ রাসেলের সহপাঠী মো. হাফিজুল হক তাঁর বাল্যবন্ধু শেখ রাসেলের স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য দেন। তিনি ৭৫-এর ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের যেসব খুনী এখনও বিদেশে অবস্থান করছে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করার দাবি জানান।
অনুষ্ঠানে শেখ রাসেলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভারতীয় শিশু অধিকার কর্মী ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী কৈলাশ সত্যার্থী’র পাঠানো ভিডিওবার্তা প্রচার করা হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে শেখ রাসেল দিবস উদযাপন উপলক্ষে স্থাপিত শেখ রাসেলের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ও আমন্ত্রিত অতিথিরা। এরপর শেখ রাসেল দিবস উপলক্ষে থিম সংগীত পরিবেশন করা হয়। অনুষ্ঠানের শেষাংশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৯৭৫ এর পনের আগস্টে শাহাদাতবরণকারী সকলের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়।