বাংলাদেশে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণ শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে। ২০১৬ সালের শেষের দিকে স্মার্ট এনআইডি (জাতীয় পরিচয়) কার্ড কার্যক্রম শুরু হয়। ইলেক্ট্রনিক চিপযুক্ত এই মেশিন রিডেবল কার্ড দেশের সকল নাগরিকদের যাবতীয় তথ্য বহন করবে। পাসপোর্ট থেকে শুরু করে ড্রাইভিং লাইসেন্স, ক্রেডিট কার্ড এমনকি জমির মালিকানা নিবন্ধন সংক্রান্ত কাজে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য যাচাইয়ে আর ঝামেলা হবে না। বরং সাধারণ সুযোগ-সুবিধাগুলো আরও একধাপ বেড়ে যাবে। এখন দেশজুড়ে সম্পূর্ণ অনলাইনে বাংলাদেশের স্মার্ট এনআইডি কার্ডের আবেদন জমা নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্ম ও নাগরিক নিবন্ধন থাকলে যে কেউ বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় পরিচয়পত্রের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এনআইডি কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারবেন। স্মার্ট এনআইডির আবেদনের নিয়ম ধাপে ধাপে উল্লেখ করা হচ্ছে আজকের নিবন্ধটিতে।
বাংলাদেশের নাগরিকদের স্মার্ট এনআইডি কার্ডের জন্য অনলাইনে আবেদনের পদ্ধতি
প্রথম ধাপ→ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুতকরণ
স্মার্ট এনআইডি কার্ড নথিভুক্ত করতে হলে আবেদনপত্রের সাথে নিম্নলিখিত সহায়ক নথিগুলো সরবরাহ করতে হবে।
→ মাধ্যমিক পরীক্ষা বা সমমানের সনদপত্র
→ অনলাইন করা জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র
→ বাবা, মা, স্বামী/স্ত্রীর এনআইডির সত্যায়িত অনুলিপি
→ ঠিকানার প্রমাণস্বরূপ ইউটিলিটির(বিদ্যুৎ/গ্যাস/পানি) বিলের অনুলিপি কিংবা বাড়ি ভাড়ার রশিদ অথবা হোল্ডিং ট্যাক্স রসিদ
আরও পড়ুন: এক এনআইডিতে ১৫টির বেশি সিমকার্ড বন্ধ করছে বিটিআরসি
দ্বিতীয় ধাপ→ অনলাইনে এনআইডি আবেদন ফর্ম পূরণ
এই প্রক্রিয়াটি শুরু হবে বাংলাদেশ এনআইডি কার্ড আবেদন ওয়েবসাইটে প্রবেশের মাধ্যমে। যারা এই প্রথম ভোটার আইডি কার্ড নিতে যাচ্ছেন তারা ‘আবেদন করুন’ বাটনে ক্লিক করবেন। এরপরে যে পেজটি আসবে সেখানে ইংরেজিতে আবেদনকারির নাম দিতে হবে। তারপর দিতে হবে আবেদনকারির জন্ম তারিখ। এরপর ক্যাপচা পূরণ করে ক্লিক করতে হবে ‘বহাল’ বাটনে। এরপরের পেজটিতে আবেদনকারির সাথে থাকা মোবাইল নম্বর প্রবেশ করিয়ে ‘সেন্ড এসএমএস’ বাটন চাপতে হবে। কিছুক্ষণ পর মোবাইলে ৬ সংখ্যার কোডটি এলে তা নির্ভুল ভাবে কম্পিউটারের ফর্মে লিখে ‘বহাল’ বাটনে ক্লিক করতে হবে। তারপরের পেজে ইউজার নেম আর পাসওয়ার্ড সেট করে ‘বহাল’ বাটনে ক্লিক করলেই তৈরি হয়ে যাবে একাউন্ট।
একাউন্টে প্রবেশের পর ‘প্রোফাইল’ অপশনে ক্লিক করে আবেদনকারি তার এনআইডির জন্য ব্যক্তিগত যাবতীয় তথ্য প্রদান করতে পারবেন। তথ্য প্রবেশ করানোর জন্য ‘এডিট’ বাটনে ক্লিক করতে হবে। এরপরেই আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত এনআইডি আবেদন ফর্ম। আবেদনকারির ইংরেজি নাম, জন্ম তারিখ ও জাতীয়তা আগে থেকেই উল্লেখ করা থাকবে। এবার শুধু বাংলা নাম ও জন্ম নিবন্ধন নাম্বার লিখে লিঙ্গ, রক্তের গ্রুপ ও জন্মস্থান বাছাই করে দিতে হবে।
তারপর বাবা-মার নাম বাংলায় ও ইংরেজিতে প্রবেশ করাতে হবে। সাথে উল্লেখ করতে হবে তাদের এনআইডি নম্বর।
আবেদনকারি বিবাহিত হলে বৈবাহিক অবস্থা উল্লেখ করে স্বামী/স্ত্রীর নাম ও এনআইডি নম্বর লিখতে হবে।
আরও পড়ুন: এনআইডির সঙ্গে থ্যালাসেমিয়ার তথ্য অন্তর্ভুক্ত কেন নয়: হাইকোর্ট
এরপরে একে একে পূরণ করতে হবে শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, অসমর্থতা, শনাক্তকরণ চিহ্ন, টিন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট ও মোবাইল নম্বর এবং ধর্ম। এখানে বলে রাখা ভালো যে শনাক্তকরণ অংশে এলাকার জানা-শোনা কারও এনআইডি নম্বর এবং প্রিন্ট করার পর তার স্বাক্ষর অবশ্যই নিতে হবে। আর যাচাইকরণের জায়গায় এলাকার চেয়ারম্যান বা পৌর মেয়র অথবা ওয়ার্ড মেম্বার, ওয়ার্ড কাউন্সিলর বামহিলা মেম্বারদের কোনো একজনের নাম, এনআইডি নম্বর এবং প্রিন্ট করার পর তার স্বাক্ষর নিতে হবে। স্বাক্ষরের নিচে তাদের সীল অবশ্যই থাকতে হবে।
এবার ঠিকানা দেয়ার পালা। এখানে নির্ভুলভাবে বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে। ভোটার এলাকা বাছাই করার সময় সাবধানে এলাকা, গ্রাম, মহল্লার নাম দিতে হবে। ভুল হলে ভোটারের নাম ভুল তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হবে।
এবার উপরে ডান পাশে ‘পরবর্তী’ বাটনে ক্লিক করলে কাগজপত্র আপলোডের পেজ আসবে। এখানে ‘কাগজপত্রের প্রয়োজন নেই’ উল্লেখ মানে বোঝাচ্ছে এই অনলাইনে কাগজপত্র আপলোড করতে হবে না। কাগজপত্র দিতে হবে আবেদন সশরীরে অফিসে জমা দেয়ার সময়। তাই এখানে সরাসরি ‘পরবর্তী’ বাটন চেপে পরের ধাপে চলে যেতে হবে।
আরও পড়ুন: এনআইডি কার্যক্রম স্থানান্তর করতে চাইলে আলোচনায় বসতে হবে: সিইসি
চূড়ান্ত ভাবে ‘সাবমিট’ বাটনে ক্লিক করলে আবার প্রোফাইল অংশে ফিরে আসবে। এখান থেকে ‘ডাউনলোড’ বাটনে ক্লিক করলে ভোটার নিবন্ধন ফর্ম ডাউনলোড হয়ে যাবে। ফর্মটি প্রিন্ট করে অপর পাতায় আবেদনকারির স্বাক্ষর বা টিপসই অবশ্যই দিতে হবে।
তৃতীয় ধাপ→ আবেদন জমা দান
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব একসাথে ভোটার নিবন্ধন ফর্মের সাথে যুক্ত করে আবেদনকারির ভোটার এলাকার নির্ধারিত উপজেলা নির্বাচন অধিদপ্তরে জমা দিতে হবে। এ সময় বায়োমেট্রিক ডাটা তথা ছবি, স্বাক্ষর, হাতের ছাপ ও চোখের আইরিশ স্ক্যান করা হবে। অতঃপর ভোটার নিবন্ধন ফর্মের নিচের অংশ কেটে আবেদনকারিকে দেয়া হবে। এটিই হচ্ছে আবেদনকারির ভোটার নিবন্ধন স্লিপ, যেটি দেখিয়ে পরবর্তীতে স্মার্ট এনআইডি কার্ড সংগ্রহ করা যাবে। এমনকি এই স্লিপে উল্লেখিত নম্বর দিয়ে অনলাইনেও স্মার্ট এনআইডি কার্ডের বর্তমান অবস্থা জানা যাবে।
এছাড়া কিছুক্ষণের মধ্যেই আবেদন ফর্মে দেয়া আবেদনকারির মোবাইল নাম্বারে এসএমএসের মাধ্যমে ১০ অঙ্কের স্মার্ট এনআইডি নম্বর পাঠানো হবে। এই নম্বর দিয়ে অনলাইন থেকে এনআইডি কার্ড ডাউনলোড করা যাবে। এটি প্রিন্ট করে বৈধভাবে ব্যবহার করা যাবে।
আরও পড়ুন: ১৪ বছরের বেশি বয়সীদের স্মার্ট এনআইডি দিতে একনেকে প্রকল্প অনুমোদন
অনলাইন থেকে এনআইডি কার্ড ডাউনলোড
আবেদনের পরে কার্ড পেতে বেশ সময় লাগবে। তাই এর মধ্যেই এনআইডি ব্যবহারের প্রয়োজন হলে অনলাইন থেকেই তা ডাউনলোড করে নেয়া যাবে। চলুন, এবার সেই নিয়মটি জেনে নেয়া যাক।
বাংলাদেশ এনআইডি পোর্টালে নিবন্ধন
আবার চলে যেতে হবে একদম শুরুর দিকে বাংলাদেশ এনআইডি কার্ড আবেদন সাইটে। এখান থেকে যেতে হবে ‘রেজিস্টার করুন’ অংশে। পরে যে পেজটি আসবে সেখানে মোবাইলের মাধ্যমে পাওয়া ১০ অঙ্কের এনআইডি নম্বর অথবা অফিস থেকে দেয়া আবেদন ফর্মের স্লিপে উল্লেখ করা নাম্বারটি দিতে হবে। তারপরে আবেদনকারির জন্ম তারিখ দিয়ে নির্দেশনা অনুযায়ী ক্যাপচা পূরণ করে সাবমিট দিতে হবে।
পরবর্তী ধাপে আবেদনকারির বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানার সাথে সম্পৃক্ত যাবতীয় তথ্য আবেদন ফর্মের যা দেয়া হয়েছিলো তার হুবহু নির্বাচন করতে হবে। তারপর “নেক্সট”-এ ক্লিক করলে আসবে মোবাইল নাম্বার যাচাইয়ের পালা। এখানে আগের মত একইভাবে আবেদনকারির সাথে থাকা মোবাইল নাম্বারটি দিয়ে “সেন্ড এসএমএস” বাটনে ক্লিক করতে হবে। সাথে সাথেই মোবাইল নাম্বারটিতে একটি ৬ অঙ্কের কোড চলে আসবে এবং এটি দিয়ে নিবন্ধনের মোবাইল যাচাইকরণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে হবে।
আরও পড়ুন: প্রবাসী বাংলাদেশিদের এনআইডি দেয়ার পরিকল্পনা ঢাকার
তারপর “কন্টিনিউ” বোতাম চাপলে সামনে চলে আসবে ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড সেট করার পেজ। এটিই নিবন্ধনের সর্বশেষ ধাপ যেখানে দেয়া নাম ও পাসওয়ার্ড দিয়ে পরবর্তীতে এই পোর্টালে লগইন করা যাবে। এনআইডি আবেদন ফর্ম পূরনের সময় যে ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড দেয়া হয়েছিলো সেই একই তথ্য এখানেও দেয়াটা উত্তম। এতে খুব সহজে মনে থাকবে।
এনআইডি কার্ড চেক ও ডাউনলোড
অনলাইন নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর ইউজার নেম, পাসওয়ার্ড ও ক্যাপচা পূরণের মাধ্যমে আবেদনকারি অ্যাকাউন্টে লগইন করতে গেলে তার মোবাইল নাম্বারে একটি সুরক্ষা কোড আসবে। এটি দিয়ে তিনি তার অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দেখতে পাবেন।
এখানে মেনু বার থেকে স্মার্ট এনআইডি কার্ড স্ট্যাটাস এবং ডাউনলোড করার শেষ সুযোগ মেনু থেকে যথাক্রমে কার্ডের বর্তমান অবস্থা জানা যাবে এবং কার্ডের সফ্ট কপি পিডিএফ ফরম্যাটে ডাউনলোড করা যাবে। এটি পরে প্রিন্ট করে বিভিন্ন কাজে লাগানো যেতে পারে।
আরও পড়ুন: জাতীয় পরিচয়পত্র হারিয়ে গেলে কি করবেন?
এসএমএস বা কল করার মাধ্যমে স্মার্ট এনআইডি কার্ড পাওয়ার সময় জানা
আবেদনকারিরা যেকোনো মোবাইল অপারেটর থেকে এসএমএস পাঠিয়ে স্মার্ট আইডি কার্ড হাতে পাওয়ার সময়টি জেনে নিতে পারবেন। এর জন্য মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে যেয়ে টাইপ করতে হবে →
SC স্পেস F স্পেস আবেদন ফর্ম জমার স্লিপ নাম্বার স্পেস D স্পেস বছর-মাস-দিন ফরম্যাট জন্ম তারিখ অর্থাৎ SC F xxxxxxx D 2000-12-31
অতঃপর পাঠিয়ে দিতে হবে ১০৫ নাম্বারে। এই নাম্বারে ফোন দিয়েও জেনে নেয়া যাবে কার্ড বিতরণের তারিখ।
শেষাংশ
স্মার্ট এনআইডি কার্ড প্রদানের পূর্বে ইসি (নির্বাচন কমিশন) কিছু কিছু ভোটারদের সাময়িকভাবে কাগজের একটি আইডি কার্ড সরবরাহ করে। স্মার্ট কার্ড যতদিন না দেয়া হচ্ছে, এই অস্থায়ী জাতীয় পরিচয়পত্রটি যে কোন ক্ষেত্রে বৈধভাবে ব্যবহার করা যাবে। যারা ইতোমধ্যে একবার ভোটার আইডি কার্ড নিয়েছেন নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী সশরীরে নির্দিষ্ট বিতরণ কেন্দ্রে এসে স্মার্ট এনআইডি কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। এ সময় অবশ্যই মূল এনআইডিটি সাথে করে নিয়ে আসতে হবে। যারা ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার পরেও কাগজের জাতীয় পরিচয়পত্র পাননি, তাদেরকে নিবন্ধনদের সময় সরবরাহকৃত মূল নিবন্ধন স্লিপটি নিয়ে আসতে হবে।
আরও পড়ুন: স্মার্ট আইডি কার্ড: জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল থাকলে যেভাবে সংশোধন করবেন
অনলাইনে বাংলাদেশের স্মার্ট এনআইডি কার্ডের আবেদন করার পদ্ধতি সহজ হলেও কার্ডটি সংগ্রহের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনায় এখনো অনেকটা বিড়ম্বনা রয়ে গেছে। এই ঘাটতি পূরন সম্ভব হলে জনসাধারণ সামগ্রিকভাবে ডিজিটাল ব্যবস্থার সুবিধা ভোগ করতে পারবে।