প্রতিদিনের লন্ড্রির কাজে সময় ও শ্রম উভয়ই বাঁচাতে একটি অপরিহার্য গৃহস্থালি যন্ত্র ওয়াশিং মেশিন। কাজ ও গঠনের ভিত্তিতে মেশিনগুলো বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। তাছাড়া নানা ধরণের পরিস্থিতিতেও এগুলোর উপযোগিতায় তারতম্য ঘটে। বর্তমান সময়ে বাসা-বাড়িতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় টপ লোড ও ফ্রন্ট লোড ওয়াশিং মেশিন। বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে দুটোরই রয়েছে কিছু সুবিধা-অসুবিধা। সেগুলো যাচাই করে চলুন দেখে নেই- সঠিক ওয়াশিং মেশিন নির্বাচনে কোন বিষয়গুলোতে গুরুত্বারোপ করা জরুরি।
টপ লোড বনাম ফ্রন্ট লোড ওয়াশার
টপ লোড মেশিনে কাপড় রাখার জন্য বৃত্তাকার ড্রামের ঢাকনা ওপর থেকে খোলা যায়। ড্রামের ভেতর কাপড় পরিষ্কার করার কাজটি করে কেন্দ্রে থাকা ফিনযুক্ত অ্যাজিটেটর নামের অংশটি। কিছু মেশিনে অ্যাজিজেটরের বদলে থাকে ইম্পেলার নামের একটি ফ্ল্যাট ডিস্ক।
অপরদিকে ফ্রন্ট লোডে কাপড় প্রবেশ করানোর জন্য ড্রামের দরজাটি সামনে থেকে খোলা হয়। এখানে পুরো ড্রামটি ঘূর্ণনের মাধ্যমে কাপড়গুলো পরিষ্কারে সাহায্য করে। এতে তুলনামূলক কম পানি ব্যবহার হয় কারণ এখানে শুধুমাত্র ড্রামের নীচের অংশ পানিতে পূর্ণ হয়। ধোয়ার পরে নোংরা
পানি একটি পাম্পের মাধ্যমে বের করে দেয়। অধিকাংশ টপ লোড-এ গরম পানি ব্যবহারের জন্য হিটার থাকে।
আরো পড়ুন: ডিপ ফ্রিজ খুঁজছেন? যেসব বিষয় জানা প্রয়োজন
টপ লোড ওয়াশিং মেশিনের সুবিধা-অসুবিধা
.
সুবিধা
ফাস্ট ওয়াশিং সাইকেল: টপ লোডিং ওয়াশিং মেশিনে খুব দ্রুত সময়ে কাপড় ধোয়ার কাজ সম্পন্ন হয়।
সাশ্রয়ী মূল্য: যারা কম দামে একটি কাপড় ধোয়ার মেশিন নিতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য এই মেশিনগুলো উপযুক্ত। শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় ফিচারগুলো থাকার কারণে এগুলোর দাম যথেষ্ট কম হয়ে থাকে।
দুর্গন্ধ নেই: টপ লোডের পানি নিষ্কাশন প্রক্রিয়াটি বেশ ভাল। এর ফলে ড্রামের ভিতরে ফাঙ্গাস বা অন্যান্য ময়লা জমে না। তাই দীর্ঘ দিন ব্যবহারে এ থেকে দুর্গন্ধের আশঙ্কা থাকে না।
ঘন ঘন বাসা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সহায়ক: যাদের ঘন ঘন বাসা পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে, এই মেশিন তাদের জন্য। এগুলোর সংযোগ স্থাপন ও বিচ্ছিন্ন করা সহজ এবং ওজনে হাল্কা হওয়ায় পরিবহনেও কোনো বিড়ম্বনা হয় না। এই কারণে টপ লোডার কম বিদ্যুৎ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এলাকায় বসবাসের জন্যও সহায়ক।
আরো পড়ুন: ডিএসএলআর ক্যামেরা খুঁজছেন? কেনার আগে জেনে নিন ফিচার ও দাম
অসুবিধা
পানি এবং বিদ্যুৎ খরচ বেশি হয়: টপ লোড ওয়াশিং মেশিনের কাপড় ধোয়ার জন্য বেশি পানি এবং বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। এটি সময়ের সঙ্গে ইউটিলিটি বিলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
কাপড় নষ্ট হয়: ফিনযুক্ত অ্যাজিটেটরের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাপড়ে (বিশেষ করে সিল্ক বা লেসের মতো সূক্ষ্ম কাপড়গুলোর ক্ষেত্রে) ছিদ্র সৃষ্টি হয়। এছাড়া কাপড়ের গুনগত মানও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ভাইব্রেশন ও শব্দ হয়: ঘোরার সময় টপ লোডারগুলোতে প্রচণ্ড কম্পন সৃষ্টি হয়। অনেক সময় ড্রামে জমাকৃত কাপড়ের ওজন যদি কমবেশি হয়, তখন এই কম্পন অতিরিক্ত শব্দের সৃষ্টি করে। বিশেষ করে সংকীর্ণ জায়গায় যেখানে একাধিক গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি কাছাকাছি থাকে এমন পরিবেশে এই ঝামেলা হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
আরো পড়ুন: হ্যাকিং প্রতিরোধ: অনলাইন কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে সাবধানতা
ফ্রন্ট লোড ওয়াশিং মেশিনের সুবিধা-অসুবিধা
সুবিধা
সীমিত পানি এবং বিদ্যুৎ খরচ: টপ লোডারের তুলনায় ফ্রন্ট লোডার কাপড় ধোয়ার জন্য কম পানি এবং বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। ফলে ইউটিলিটি বিলের ওপর খুব একটা চাপ পড়ে না।
কাপড় নষ্ট হয় না: পুরো ড্রামের ঘূর্ণনের ফলে ভেতরে থাকা কাপড়গুলোতে যে আন্দোলন হয় তাতে সেগুলোর তেমন ক্ষতি হয় না। তাই কোনো রকম ছিদ্র বা গুনগত মানের অবনতি ঘটার আশঙ্কা নেই। তবে এর জন্য সঠিক সেটিংসে মেশিন অপারেট করা প্রয়োজন। ভুল সাইকেল বা তাপমাত্রা সেট করা হলে কাপড় সঙ্কুচিত বা বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে। তাই কেনার পরে প্রথম চালানোর সময় একটু সময় নিয়ে হলেও সেটিংসগুলো ভালভাবে জেনে নেওয়া উচিত।
ভাল পরিষ্কার হয়: টপলোডারের তুলনায় এই মেশিনে কাপড় ভালভাবে পরিস্কার হয়। শক্ত বা কালো দাগ মুছে ফেলার ক্ষেত্রে এগুলোর কার্যকারিতা বেশি।
উন্নত প্রযুক্তির ফিচার: ফ্রন্ট লোড ওয়াশারগুলোতে প্রায় ক্ষেত্রে উন্নত বৈশিষ্ট্যগুলো যোগ করতে দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফোনের মাধ্যমে মেশিন নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন ধরণের কাপড়ের জন্য কাস্টম ওয়াশ সেটিংস এবং শব্দহীন অপারেশনের জন্য ইনভার্টার মোটর।
হিটার এবং ঘূর্ণন নিয়ন্ত্রণের সুবিধা: বেশিরভাগ ফ্রন্ট লোডারে বিল্ট-ইন হিটার থাকে। শক্ত দাগ দূর করার ক্ষেত্রে হিটার যথেষ্ট কার্যকর। এছাড়া ড্রামের ঘূর্ণন গতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটি কাপড় শুকানোর জন্য সাহায্য করে। দীর্ঘক্ষণ যাবৎ একই গতিতে চালালে অনেক সময় সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশগুলোর ক্ষতি হতে পারে। গতি নিয়ন্ত্রণ সুবিধাটি এই ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারে।
কম জায়গা নেয়: এই মেশিন স্থাপনের জন্য খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন হয় না। তাই ছোট বাসার জন্য ফ্রন্ট লোডার বেশ উপযোগী।
চাইল্ড সেফটি ফিচার: ফ্রন্ট লোড ওয়াশিং মেশিনের বিল্ট-ইন চাইল্ড লক খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সুবিধা। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে মেশিন চালু থাকা অবস্থায় বাচ্চারা দুর্ঘটনাক্রমে মেশিনের দরজা খুলে ফেলতে পারে না।
আরো পড়ুন: স্মার্টফোনে ভূমিকম্প সতর্কতা চালু করবেন যেভাবে
অসুবিধা
খরচ বেশি: মেশিনের দক্ষতা বাড়ানো জন্য বিভিন্ন ধরণের ফিচার যুক্ত থাকায় স্বাভাবিকভাবেই এগুলোর দাম বেশি হয়ে থাকে।
পরিষ্কারে সময় বেশি নেয়: ফ্রন্ট লোডারে লন্ড্রির কাজ শেষ হওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়।
ফাঙ্গাস জমতে পারে: রাবারের দরজার সিলে আর্দ্রতাজনিত কারণে প্রায়ই এই মেশিনগুলোতে ফাঙ্গাস জমে। তাই ব্যবহারের পর কিছু সময় দরজাটি খোলা রাখতে হয়। এছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে কোনো দুর্গন্ধ ছাড়া ফ্রন্ট লোড ব্যবহার করতে হলে এটি নিয়মিত পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ঝামেলা: বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা মেশিন চালু থাকার সময় মাঝে বন্ধ করার প্রয়োজন হলে, তা যথেষ্ট বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ডিটারজেন্ট যোগ করতে ভুলে গেলে বা কোনো কারণে ভেতর থেকে কোনো কাপড় বের করতে হলে।
অতিরিক্ত ডিটারজেন্ট বেরিয়ে আসতে পারে: ভুলবশত খুব বেশি ডিটারজেন্ট যোগ করে ফেললে মেশিন চলার সময় তা দরজা গলে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে।
আরো পড়ুন: নারীর নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত সুরক্ষায় মোবাইল অ্যাপ
টপ বা ফ্রন্ট লোড ওয়াশিং মেশিন কেনার সময় কোন কোন বিষয়গুলো দেখা জরুরি
.
দিনে লন্ড্রি ব্যবহারের পরিমাণ
একটি যৌথ পরিবার থাকে সারা দিনে দুইয়ের অধিকবার কাপড় ধোয়ার প্রয়োজন পড়ে। প্রতিবারে বেশি সংখ্যক লোড ধারণের জন্য এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত হতে পারে টপ লোডার মেশিন। অপরদিকে, নিয়মিত স্বল্প সংখ্যক কাপড় পরিষ্কারের জন্য ফ্রন্ট লোডারই যথেষ্ট।
ঘরের জায়গা এবং প্লাম্বিং সেটআপ
এ ধরণের মেশিনের জন্য বাসায় জায়গা সঙ্কুলান হওয়াটা একটু গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার। বিশেষ করে স্থাপনের ক্ষেত্রে আগে থেকেই প্লাম্বিং-এর সেটআপ ঠিক করে রাখা দরকার হয়। ফ্রন্ট লোড ওয়াশার ছোট বাসাতে অনায়াসেই স্থাপন করা যায়। তবে ড্রেন পাইপটি মেঝে বরাবর সেট করা নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। কম জায়গা লাগলেও দরজা সম্পূর্ণরূপে খোলার জন্য সামনে যথেষ্ট জায়গা রাখতে হবে।
কাপড়ের ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে
শুধুমাত্র ধোয়া বা পরিষ্কার করাটাই মূখ্য বিষয় নয়। পরিষ্কার কাপড়টি কতটুকু ভালো থাকছে এবং তা পরবর্তীতে কতদিন পর্যন্ত পরিধান করা যাবে, সেটাও বিবেচনায় আনা আবশ্যক। তাই কোন ধরণের কাপড় বেশি পড়া হয় সেদিকে খেয়াল রেখে ওয়াশিং মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
বাজেট এবং রক্ষণাবেক্ষণ
শুধুমাত্র ক্রয়মূল্যই নয়, কেনার পরে মেশিনের রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ খরচ এবং ইউটিলিটি বিলকেও বিবেচনায় আনা জরুরি। টপ লোডারগুলো শুরুতে বাজেট-বান্ধব হলেও দীর্ঘমেয়াদে অর্থ সাশ্রয় করে ফ্রন্ট লোডারগুলো। উপরন্তু, ফ্রন্ট লোডের মেশিনে ফাঙ্গাস বা দুর্গন্ধ রোধ করতে নিয়মিত পরিষ্কারের জটিলতা রয়েছে।
ঘন ঘন বাসা পরিবর্তন করা হয় কিনা
বাসা পরিবর্তন মানেই গৃহস্থালি যন্ত্রপাতির পুনঃস্থাপন এবং পরিবহন ঝামেলা পোহানো। এ ক্ষেত্রে সহজে স্থানান্তরযোগ্য হাল্কা টপ লোডারগুলো উত্তম। অপরদিকে, যারা নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন তাদের জন্য ফ্রন্ট লোড ওয়াশার-ড্রায়ার কম্বোতে বিনিয়োগ করাটাই শ্রেয়।
আরো পড়ুন: অ্যাপলের আইফোন ১৬ সিরিজ উদ্বোধন: নতুন ফিচার ও মূল্য তালিকা
শেষাংশ
সর্বসাকূলে, কাপড় দ্রুত পরিষ্কারের ক্ষেত্রে এবং ভাড়াটে ব্যবহারকারীদের জন্য উপযুক্ত হবে সাশ্রয়ী টপ লোড ওয়াশিং মেশিন নেওয়া। অপরদিকে কাপড়ের যত্ন, স্বল্প জায়গা এবং পানি ও বিদ্যুৎ খরচের বিচারে এগিয়ে থাকবে ফ্রন্ট লোড ওয়াশিং মেশিনগুলো। এছাড়া প্রযুক্তি-বান্ধব উন্নত বৈশিষ্ট্যগুলো পেতে হলে ফ্রন্ট লোডের বিকল্প নেই। উপরুন্তু, কেনার পরে রক্ষণাবেক্ষণের খরচের সাথে দিনে কতটুকু লন্ড্রি ব্যবহার করা হচ্ছে সেই বিষয়টিও সম্পৃক্ত। সব মিলিয়ে, ওয়াশিং মেশিনটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া পরিবারের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তাকে মূল্যায়ন করা উচিত।
আরো পড়ুন: মোবাইল ফোন বিস্ফোরণ: কারণ ও বাঁচার উপায়