শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্র-ছাত্রীরাও পড়েছে বিপাকে। অনেক শিক্ষার্থীই ক্যাম্পাসে থাকা অবস্থায় টিউশনি করে খরচ চালিয়ে নিতে পারলেও করোনার কারণে ছুটিতে বাড়িতে চলে আসায় সে আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে, তাদের ব্যয় সংকোচিত হয়নি। মোবাইলে ডাটার খরচ, সহপাঠি-শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ, অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন ক্লাসে অংশগ্রহণ সব মিলিয়ে ব্যক্তিগত ব্যয় যথেষ্ট বেড়েছে।
এমন বাস্তবতায় বেঁচে থাকার তাগিদে এবং দৈনন্দিন খরচ যোগাতে শেরপুরে শান্ত নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র এখন দোকান কর্মচারির কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
শেরপুরে শ্রীবরদী উপজেলার গড়জরিপা ইউনিয়নের চাউলিয়া গ্রামের দরিদ্র রিকশাচালকের ৫ সদস্যের পরিবারে সবার ছোট সন্তান আব্দুর সাত্তার শান্ত।
চোখে বড় হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও দারিদ্র্য ছিল বড় বাঁধা। ছোটবেলায় সে দর্জির দোকানে কাজ করে, কখনও বা চায়ের দোকানে কাজ করে পরিবারকে সহায়তার পাশপাশি লেখাপড়া চালিয়ে গেছে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে অন্য দুই ভাই শ্রমিক পেশায় চলে গেলেও শান্ত তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ডপস’ (দরিদ্র অসহায় শিক্ষার্থী উন্নয়ন সংস্থা)-এর সহায়তায় সে উচ্চশিক্ষার পথে পাড়ি জমাতে পেরেছে।
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে স্নাতক শেষবর্ষের শিক্ষার্থী শান্ত। শিক্ষাজীবন শেষ করে স্বপ্নের ডানামেলার এ সময়ে হানা দিয়েছে করোনাভাইরাস। মহামারির করোনা পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে তাই দোকান কর্মচারীর কাজে নাম লেখালেন শান্ত।
বাবা রিকশা চালিয়ে সংসার চালালেও বয়সের ভারে এখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না। তাই বাড়ির পাশে বাজার পাহাড়াদারের কাজ নিয়েছেন। অভাবের সংসারে কাজকর্ম সীমিত থাকায় আয়ের পথ বন্ধ হওয়ায় বাবা-মার মলিন মুখ আর করুণ চাহনি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শান্তকে ভাবিয়ে তোলে।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া আর সারাজীবন অক্লান্ত-পরিশ্রান্ত বাবার শরীরের দিকে তাকালে যে কারো বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠবে। এ বয়সেও দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন তার বাবা। রাত জেগে বাজার পাহাড়াদারের কাজ করে যাচ্ছেন।
দেশে করোনা হানা দেয়ার পর থেকেই বাবাকে একটুখানি সহায়তা করতে কাজের খোঁজ করতে থাকেন। কোথাও কোনো কিছু না হওয়ায় ইজিবাইক চালানোর জন্য মনস্থির করেন। পরে, গত ২৮ মে থেকে বাড়ির পাশের চাউলিয়া বাজারে একটি মোবাইল রিচার্জ কাম ওষুধের দোকানে কর্মচারির কাজ নেন।
এখন প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই দোকানে কর্মচারীর কাজ করছেন শান্ত। বুধবার বিকালে আব্দুস সাত্তার শান্তর সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয়।
শান্ত বলেন, ‘গোপালগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে স্যাররা আমাকে একটি লজিং (গৃহশিক্ষক) ঠিক করে দিয়েছেন। সেখানে দুজনকে পড়ানোর বিনিময়ে ওই বাসায় থাকা-খাওয়া আর টিউশনির মাধ্যমে আমার লেখাপড়া এগিয়ে চলেছে। করোনার কারণে বাড়ি চলে আসার পর আমি খুব বিপাকে পড়ে যাই। আমাকে টিকে থাকতে হবে, তাই করোনার সময় পার করার জন্য কাজ খুঁজতে থাকি। কিন্তু এই সময়ে কেউ কোনো কাজে নিতে চাননি। শেষ পর্যন্ত দোকান মালিক আমাকে তার ওষুধের দোকানে কিছু আর্থিক সহায়তার বিনিময়ে কর্মচারি হিসেবে নিয়েছেন। বেতন যাই দিক, অন্তত খাওয়াটাতো চলবে। এজন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।’
দরিদ্র-অসহায় শিক্ষার্থী উন্নয়ন সংস্থা ‘ডপস’ প্রতিষ্ঠাতা শাহীন মিয়া বিএসপি জানান, ‘শান্ত দর্জির দোকানে, চা-রুটির দোকানে কাজ করে পড়ালেখা করতো। বিভিন্ন সমস্যায় যখন পড়ালেখা ছেড়ে দেয়ার উপক্রম হয়েছে, তখন পাশে দাঁড়িয়ে সাহস জুগিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ডপস’।
তিনি আরও বলেন, অনেক শিক্ষার্থী যারা চক্ষু লজ্জায় প্রয়োজনীয় অনেক কথাই বলতে পারছে না। জন্মের পর থেকে হাজারো প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছানো এসব শিক্ষার্থীদের আর মাত্র কয়েকটা মাস/বছর পরই জীবনে উদিত হতে যাচ্ছে সফলতার সূর্য।
সমাজের যারা সামর্থবান রয়েছেন তাদেরকে ওই সব দরিদ্র শিক্ষার্থীদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া আহ্বান জানান তিনি।