চট্টগ্রাম, ০৩ ফেব্রুয়ারি (ইউএনবি)- চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্মকর্তার কোটিপতি স্ত্রীদের দিন কাটছে দুদক আতঙ্কে। কারণ, চট্টগ্রামে কাস্টমস কর্মকর্তাদের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে অনুসন্ধানে নেমেছেন দুদক কর্মকর্তারা। দুদকের অনুসন্ধানী জালে রয়েছেন ওইসব কর্মকর্তাদের স্ত্রীরাও।
অভিযোগ, কোটিপতি কাস্টমস কর্মকর্তারা শেষরক্ষার ঢাল হিসেবে স্ত্রীদের নামে ব্যাংকে তাদের জ্ঞাত আয়বহির্ভুত অর্জিত সম্পদ জমা করছেন।
জানা গেছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম কাস্টমসের প্রায় অর্ধশত দুর্নীতি মামলার তদন্ত করছে দুদক। পাশাপাশি প্রায় শতাধিক অভিযোগের অনুসন্ধানও চালাচ্ছে সংস্থাটি। সবক’টি মামলায়ই চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের স্ত্রীরা আসামি।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য ইউএনবিকে জানান, দেশের চট্টগ্রাম কাস্টমসের বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের স্ত্রীরা কোটিপতি। এমনকি কোনো রকম আয়ের উৎস না থাকলেও স্ত্রীরা কোটিপতি বনে গেছেন।
তিনি আরও জানান, তদন্তাধীন ৫৫টি মামলা ৮২টি অভিযোগের বেশির ভাগই চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ ঘিরে। মামলার অধিকাংশ আসামি কাস্টমস হাউজের কর্মকর্তা এবং তাদের স্ত্রী।
গত ১০ জানুয়ারি ৬ লাখ ঘুষের টাকাসহ চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে দুদকের চট্টগ্রাম জেলার সমন্বিত টিম। এরপর গত ১৬ জানুয়ারি ও ২২ জানুয়ারি দুই দফায় একদিন করে রিমান্ডে থাকা নাজিম উদ্দিনের কাছ থেকে দুর্নীতির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে বলে জানিয়েছে দুদক।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, নাজিম উদ্দিন গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তার স্ত্রী ও স্বজনরা গা ঢাকা দিয়েছেন। রয়েছেন গ্রেপ্তার আতংকে। এর আগে চট্টগ্রামে কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন হাজারী এবং তার স্ত্রী হালিমার বিরুদ্ধে গত ৬ই জানুয়ারি অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে নগরের ডবলমুরিং থানায় মামলা করে দুদক। মামলার এজাহারে বলা হয়, আমজাদের স্ত্রী গৃহিণী হলেও তিনি ৩ কোটি ২ লাখ ৩২ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মালিক।
দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের অন্তত দশজন কর্মকর্তা এবং তাদের স্ত্রীদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এসব মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।
২০১৭ সালের ১৯ মে কাস্টমস কর্মকর্তা আবদুল মমিন মজুমদারকে গ্রেপ্তার করে দুদক। তার বিরুদ্ধে করা মামলায় অভিযোগ করা হয়, আবদুল মমিন মজুমদার এবং তার স্ত্রী সেলিনা জামান পরস্পর যোগসাজশে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
একই বছরের মে মাসে ৪৪ লাখ ৮৮ হাজার ১৬৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সাবেক আপ্রেইজার আবুল কালাম আজাদ ও তার স্ত্রী মাসুমা আক্তারের বিরুদ্ধেওও মামলা করে দুদক। সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে কাস্টমসের প্রিভেন্টিভ শাখার সুপারিনটেনডেন্ট মনজুরুল হক চৌধুরীর স্ত্রী আকতার জাহান লাইলীর বিরুদ্ধেও মামলা করে সংস্থাটি।
সূত্র জানায়, বৈধ কোনো আয়ের উৎস না থাকা সত্ত্বেও দেড় কোটি টাকার মালিক বনেছেন গৃহিণী রাফেয়া বেগম। তার স্বামী চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের একজন কর্মচারী। একইভাবে আড়াই কোটি টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সমপদ অর্জনের অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কর্মচারী এসএম জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী রাফেয়া বেগম ওরফে নাজমা হায়দার রাফিয়ার বিরুদ্ধেও করা দুর্নীতি মামলারও তদন্ত করছে দুদক।
এদিকে পরিবারের ১১ জনের নামে সাড়ে ৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রাখার অভিযোগে কাস্টমসের সহকারী কমিশনার শরীফ আল আমীনের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে মামলা করেছেন দুদক। এ মামলায় আল আমীনের স্ত্রীসহ তার পরিবারের ১১ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটি এখনো তদন্তাধীন।
কোটিপতি কাষ্টমস কর্মকর্তারা স্ত্রীকে শেষরক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী মুঠোফোনে ইউএনবি বলেন, স্ত্রীদের শেষরক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা কোটিপতি কাষ্টমস কর্মকর্তাদের মধ্যে বাড়ছে। যা একটা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নীতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেক সময় স্ত্রীদের সম্পতি না থাকলেও স্বামীরা স্ত্রীর নামে ব্যাংকে হিসাব খুলে অর্জনকৃত অবৈধ সম্পদ জমা করছেন। স্ত্রীর নামে জায়গা-জমি কিনছেন। এটিও নারী নির্যাতনের মধ্যেই পড়ে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের সাবেক উচ্চমান সহকারী রফিকুল ইসলাম পাটোয়ারি ও তার স্ত্রী শাহীনের বিরুদ্ধে দুদকের দায়েরকৃত মামলায় সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৮৮ লাখ ৯০ হাজার ৫৯৬ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়।
এছাড়াও কাস্টম কর্মকর্তা আবদুল মমিন মজুমদার ও তার স্ত্রী সেলিনা জামান পরস্পর যোগসাজশে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন। এ ছাড়াও ৪০ লাখ ২৩ হাজার ৮৫৮ টাকার সম্পদ গোপনের অভিযোগ থাকায় দুদক তাদেরকে গ্রেপ্তার করে।
দুদক সূত্র জানায়, আয়ের বৈধ কোনো উৎস না থাকার পরও চট্টগ্রামের হালিশহর এল ব্লকে (লেন ৩, সড়ক ২, প্লট ১৩) তিন কাঠা জমি ও আংশিক দালানগৃহ ২০ লাখ টাকায় কেনেন সেলিনা জামান। এরপর চট্টগ্রামে ছয়তলা ভবন তৈরি করেন তিনি। এর নির্মাণ ব্যয় ৬৫ লাখ ৪২ হাজার ৯৮০ টাকা। আবার কাস্টম কর্মকর্তা মমিন নিজ নামে ৫৯/২, আর কে মিশন রোডে ৭৮০ বর্গফুটের পার্কিংসহ একটি ফ্ল্যাট কেনেন। সেলিনা জামান তার আয়কর নথিতে ২০০৪-০৫ কর বর্ষ থেকে ২০১১-১২ পর্যন্ত মোট ৭৪ লাখ ২৭ হাজার ১৯ টাকা আয় দেখান। অথচ এত টাকা আয় হওয়ার বৈধ কোনো উৎসই তার নেই।
একইভাবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী এসএম জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী রাফেয়া বেগম ওরফে নাজমা হায়দার রাফিয়ার বিরুদ্ধেও দুর্নীতি মামলা চলছে। এ দম্পতির বিরুদ্ধে মোট আড়াই কোটি টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত উপার্জন করার অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অফিস সুপারভাইজার পদে চাকরি করা এসএম জাহাঙ্গীর আলম খুলনার ফুলতলায় ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই ইউনিটের চারতলা বাড়ি এবং গ্রামে ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে একতলা আরও একটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া তার নিজ নামে খুলনায় প্রায় ১৪ লাখ টাকার জমি রয়েছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে উচ্চমান সহকারী পদে থেকেই জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রাফেয়া বেগম দেড় কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে খুলনার সোনাডাঙ্গায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি তিনতলা বিল্ডিং, ৭৭ শতাংশ জমি ও সাড়ে ৫ লাখ টাকায় কেনা টয়োটা গাড়ি।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সাবেক অ্যাপ্রেইজার আবুল কালাম আজাদ ও তার স্ত্রী মাসুমা আক্তারের বিরুদ্ধেও ৪৪ লাখ ৮৮ হাজার ১৬৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ এবং ৩৮ লাখ ২৯ হাজার ৩২০ টাকার সমপরিমাণ সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা দায়ের করে দুদক।
এদিকে প্রায় ৫৪ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং প্রায় ১৪ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অপরাধে আকতার জাহান লাইলী নামে এক গৃহবধূর বিরুদ্ধে মামলা চলছে দুদকের। লাইলী চট্টগ্রাম কাস্টমসের প্রিভেন্টিভ শাখার সুপারিনটেনডেন্ট মনজুরুল হক চৌধুরীর স্ত্রী।
স্ত্রী, মা, বোনসহ পরিবারের ১১ জনের নামে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রাখার অভিযোগে কাস্টমসের সহকারী কমিশনার শরীফ মো. আল আমীনের বিরুদ্ধে গত বছর মামলা করেছে দুদক। এ মামলায় আল আমীন ছাড়াও তার মা শরীফ হাসিনা আজিম, বোন শরীফা খানম, স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানা, তাদের আত্মীয় সোনালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার রেজওয়ানুল হক, রাবেয়া আক্তার, ছালেহা বেগম, এসএম খাইরুলল আলম, কাজী নাদিমুজ্জামান, এমএম হুমায়ুন কবির ও ফাতেমা বাচ্চুকে আসামি করা হয়।
কাস্টমসে চাকরির মাত্র আড়াই বছরের মধ্যেই আল আমীন সোনালী ব্যাংকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় নিজ নামে ৮০ লাখ টাকার এফডিআর, তার মা শরীফ হাসিনা আজিম ও বোন শরীফা খানমের নামে ৭৫ লাখ টাকা করে দুটি এফডিআর করেন। তিনি ৩৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকায় একটি গাড়িও কেনেন। আল আমিন অবশিষ্ট অবৈধ সম্পদ রাখেন পরিবারের অন্য নিকটাত্মীয়দের নামে।
এদিকে কাস্টমস কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন, তার স্ত্রী ও ছেলের বিরুদ্ধেও চলছে দুর্নীতি মামলা। পরস্পর যোগসাজশে অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধেও মামলা করে দুদক।
দুদক কর্মকর্তা লুৎফুল কবীর চন্দন ইউএনবিকে বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই তাদের অবৈধ আয়ের মালিক বানিয়েছেন স্ত্রীকে। দায় এড়াতে তারা এ কৌশল নিলেও আমরা মামলার আসামি করছি স্বামী-স্ত্রী দু'জনকেই। তবে বেশিরভাগ কাষ্টমস কর্মকর্তারা নিজেদের শেষরক্ষা করতেই স্ত্রীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাদের নামে ব্যাংকে সম্পদ জমা করেছেন। সেই বিষয়টিও দুদক গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ছদ্মবেশে বিভিন্ন সরকারি ও আধা সরকারি অফিস ও হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘোরাফেরা করছে। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়মভঙ্গকারী ও দুর্নীতিবাজদের ধরতেই তাদের এ অভিযান।