প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকার কথা থাকলেও চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্থানীয়দের অভিযোগ-ক্লিনিকগুলো সকাল ১০টা থেকে ১১টার দিকে খোলা হয়। আবার দুপুর ১টা বাজতেই বন্ধের তোড়জোড় শুরু করেন এর কর্মীরা।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে টেংরা কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার রাজু আহমেদ জানান, ইপিআই টিকা কার্যক্রম ও উপজেলার মিটিং ছাড়া প্রতিদিনই তিনি সময় মত অফিস করেন। মাঝে মধ্যে দুই একদিন পারিবারিক কারণে দেরি হয় বলেও স্বীকার করেন তিনি।
নিয়ম অনুযায়ী, কমিউনিটি ক্লিনিকে সপ্তাহে দুইদিন একজন উপ-সহকারী মেডিকেল কর্মকর্তা, ছয়দিন একজন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) এবং তিন দিন একজন স্বাস্থ্য সহকারী (এইচএ) ও একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী উপস্থিত থাকার কথা।
এ ব্যাপারে যশোরের শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. অশোক কুমার সাহা জানান, এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরতদের উপস্থিতি রেকর্ড রাখার জন্য কোনো রেজিস্ট্রার খাতার ব্যবস্থা নেই। রোগীকে দেয়া ওষুধ একটা রেজিস্ট্রার খাতায় লিখে রাখতে হয়, সেটাই ওদের উপস্থিতির প্রমাণ হিসেবে দেখা হয়। আর কমিউনিটি ক্লিনিকের লোকজন ঠিক মত কাজ করছেন কিনা তা দেখার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে বলে জানান তিনি। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্বে থাকেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড মেম্বার (সদস্য)।
যশোরের শার্শা উপজেলার বিভিন্ন ক্লিনিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারই (সিএইচসিপি) হচ্ছেন কমিউনিটি ক্লিনিকের মূল ব্যক্তি। সপ্তাহে ছয় দিন তিনি ক্লিনিকে বসেন। তবে তাকে সহায়তা করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের একজন স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের একজন পরিবার কল্যাণ সহকারীর সপ্তাহে তিন দিন করে ক্লিনিকে বসার কথা থাকলেও তারা সপ্তাহের ঠিক কোন দিন বসেন তা অধিকাংশেরই জানা নেই। এমনকি তারা নিয়মিত ক্লিনিকে আসেন না।
বেনাপোলের পোড়াবাড়ি নারানপুর কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) সোনিয়া পারভীন জানান, তাদের মূল বেতন ১০ হাজার ২০০ টাকা। সর্বসাকুল্যে পান ১৬ হাজার ৭০০ টাকা। তাদের বেতন রাজস্ব খাতে না হওয়ায় অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সময় মত না খোলা ছাড়াও গ্রামীণ জনপদের মানুষের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা এসব ক্লিনিক থেকে পায় না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
টেংরা কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি পল্লী চিকিৎসক মুত্তাজুর রহমান বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকে নিরাপদ প্রসবের ব্যবস্থার কথা বলা হলেও তার কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই। তবে পরামর্শ দেয়া হয়। স্থায়ী চিকিৎসক না থাকায় ক্লিনিকগুলো মানুষের আস্থা হারাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
সামটা ও টেংরা গ্রামের হাজার খানেক মানুষ আর্সেনিক আক্রান্ত উল্লেখ করে সামটা গ্রামের বাসিন্দা বাঘাছড়া ইউপির ৯নং ওয়ার্ড মেম্বার জিয়াউল ইসলাম জানান, এক যুগে অন্তত ১৫ জন এই রোগে মারা গেছে কিন্তু টেংরা কমিউনিটি ক্লিনিকে আর্সেনিক আক্রান্তের কোনো ওষুধ নেই। স্থানীয়রা যে সব রোগে ভুগছেন তার চিকিৎসা ব্যবস্থা আর স্থায়ীভাবে চিকিৎসক না থাকলে এসব ক্লিনিক মুখ থুবড়ে পড়বে।
শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. নাজমুন নাহার রানী জানান, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা সাধারণত ঠান্ডা, জ্বর, গ্যাস্ট্রিক, ডায়রিয়ার মত সাধারণ অসুখের জন্য ওষুধ দিয়ে থাকেন। ওষুধ দেয়ার পাশাপাশি তারা কাটা-ছেঁড়া কিংবা কোথাও ভেঙে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
এর বাইরে টিকাদান, পরিবার পরিকল্পনা, জন্মনিয়ন্ত্রণ, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ ও সেবা দিয়ে থাকে কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীরা বলে জানান তিনি।
তবে ‘সিএইচসিপিরা তো আর ডাক্তার না’ উল্লেখ করে টেংরা কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ইউপি ওয়ার্ড মেম্বার মোজাম গাজী বলেন, তারা যেভাবে ওষুধ দেয় তা মুদি দোকানিরাও দিতে পারে। চিকিৎসকের অভাবে ক্লিনিকগুলো আস্থা হারাচ্ছে। এখানে স্থায়ীভাবে ডাক্তার দিলে জনগণ উপকৃত হবে বলে তিনি মনে করেন।
যশোরের শার্শা উপজেলায় এ ধরনের মোট ৩৯টি ক্লিনিক রয়েছে। এখানে সরকারিভাবে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দেয়া হয়।
গ্রামের মানুষের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, স্বাস্থ্য শিক্ষা, বিনামূল্যে ওষুধ, পুষ্টি, নবজাতক, গর্ভবতী ও প্রসূতির সেবার ব্যবস্থার লক্ষ্য নিয়ে প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিটি সাবেক ওয়ার্ডে একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার মাঠে নেমে ২০০১ সাল পর্যন্ত ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিক চালু করে।
২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ করে দেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরে আসার পর আবার চালু করা হয় কমিউনিটি ক্লিনিক।