বাগেরহাট, ২৬ অক্টোবর (ইউএনবি)- বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ স্থাপত্যশৈলী বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম পুরার্কীতির একটি। লাল পোড়া ইটের ওপর নয়নাভিরাম কারুকার্য খচিত বহুগম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটির ইটের দেয়ালে ভেতর এবং বাইরের অংশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন টেরাকোটা।
তুঘলক স্থাপত্য বৈশিষ্টে বাংলাদেশে যে কয়টি মসজিদ রয়েছে তার মধ্যে ষাটগম্বুজ মসজিদ অন্যতম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে চমৎকার মসজিদ স্থাপত্য নিদর্শন এই ষাটগম্বুজ মসজিদ। জনশ্রুতি রয়েছে মসজি নির্মাণের সময় চুন-সুড়কির সাথে মধু ব্যবহার করা হয়েছে।
বাগেরহাট শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়কের উত্তর পাশে সুন্দরঘোনা গ্রামে ষাটগম্বুজ মসজিদের অবস্থান। ওই সড়কে চলতে যে কারো নজরে পড়বে অনন্য স্থাপত্যশৈলী মসজিদটির দিকে।
১৬৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১০৮ ফুট প্রস্থের মসজিদের দেয়ালগুলো আট ফুট করে পুরু। এতে গোলাকার গম্বুজ রয়েছে ৭০টি, চারচালা বিশিষ্ট গম্বুজ রয়েছে সাতটি এবং কর্ণার বুরুজ রয়েছে চারটি। সব মিলে মোট ৮১টি গম্বুজ রয়েছে ষাটগম্বুজ মসজিদে।
এছাড়াও পাথরের তৈরি ৬০টি খাম্বা, ১০টি মেহেরাব, ২৫টি খিলান দরজা এবং একটি কিবলা দেয়ালে দরজা রয়েছে। মসজিদটির নির্মাণে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে পোড়ামাটির তৈরি টালি, ইট, চুন, সুরকি, পাথর এবং টেরাকোটা।
ষাটগম্বুজ মসজিদের ইমাম মো. হেলাল উদ্দিন জানান, মসজিদে সাধারণত মেহে্রাব থাকে একটি। কিন্তু এই মসজিদে মেহেরাবের সংখ্যা ১০টি। প্রধান মেহেরাবটি পাথরের। সেই স্থানটিকে বলা হয় কোট অব খানজাহান। সেখানে খানজাহান দরবার বসাতেন। দরবারের পর শিক্ষা-দীক্ষা এবং তালিম করতেন খানহাজান।
মদিনার মসজিদের আদলে ষাটগম্বুজ মসজিদের ডান পাশে একটি দরজা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ওই দরজা দিয়ে হয়রত খান-উল আজম উলুঘ খান-ই-জাহান আসা যাওয়া করতেন। এখনো ওই দরজাটি বিদ্যমান রয়েছে।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে নির্মিত ষাটগম্বুজ মসজিদের নামকরণ নিয়ে মূলত তিনটি জনশ্রুতি রয়েছে- ছাদগম্বুজ থেকে ষাটগম্বুজ, ষাটখাম্বুজ (৬০টি পিলার) থেকে ষাটগম্বুজ এবং কারো কারো মতে ফারসি শব্দ সোয়াস্তু খাম্বুজ থেকে ষাটগম্বুজ মসজিদ। তবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মনে করে, অর্ধ ডিম্বাকার এবং আয়তাকার গম্বুজগুলোই ছাদ। এজন্য এই মসজিদকে ‘ছাদগম্বুজ’ মসজিদ বলা হতো।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তথ্য মতে, ১৯২৩ সালে বৃটিশ সরকারের সময় ষাটগম্বুজ মসজিদ প্রথম, পাকিস্তান সরকারের সময়ে দ্বিতীয়বার এবং ২০১৪ সালে দক্ষিণ এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মসজিদটির তৃতীয়বার সংস্কার কাজ করা হয়েছে।
এছাড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তাদের কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে নিয়মিত সংরক্ষণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো ষাটগম্বুজ মসজিদসহ খানজাহানের স্থাপত্যগুলো তালিকাভুক্ত করে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বাগেরহাট যাদুঘরের কাস্টোডিয়ান এবং গবেষক গোলাম ফৈরদৌস জানান, মসজিদটির সঠিক ইতিহাস প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জানা নেই। খানজাহান সম্পর্কে জানার একমাত্র প্রত্নতত্ত্ব বিশুদ্ধ মাধ্যম হচ্ছে, খানজাহান (রহ:) তার জীবদ্দশায় মাজারে রেখে যাওয়া লিপিবদ্ধ শিলা। ওই শিলালিপিতে নাম লেখা আছে, খান-উল-আজম উলুঘ খান-ই-জাহান।
১৪৫৯ সালের পূর্বে কোনো এক সময় ঐতিহাসিক এই মসজিদ নির্মাণ করেছেন বলে শিলাতে লিপিবদ্ধ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এছাড়া খানজাহান সম্পর্কে যা শুনা যায় সবই জনশ্রুতি।
কাস্টোডিয়ান গোলাম ফৈরদৌস বলেন, মধ্যে এশিয়ার বিশেষ করে উজবেকিস্তানের বিবি খানম মসজিদের আদলে এই ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। ‘ছাদগম্বুজ’ থেকে সময়ের পরিক্রমায় ষাটগম্বুজ নামকরণ হয়েছে বলে ওই কাস্টোডিয়ানের অধিকতর ধারণা। খানজাহানকে নিয়ে গবেষণার দাবি জানান তিনি।
ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আকতারুজ্জামান বাচ্চু বলেন, জনশ্রুতি আছে হয়রত পীর খানজাহান (রহ:) প্রথমে তুঘলক সেনাবাহিনীর সেনাপতি হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। তার কিছু কাল পরে তিনি প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এর পরে ভারতের জৈনপুরে গভর্নর হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে এই অঞ্চলে আসেন তিনি।
ওই জনশ্রুতির সূত্র ধরে চেয়ারম্যান শেখ আকতারুজ্জামান বাচ্চু আরও বলেন, খানজাহান (রহ:) প্রথমে এই অঞ্চলের যশোরের বারোবাজারে আসেন। সেখানে আসার পর যশোর বারোবাজার, কসবা এবং পয়োগ্রাম কসবা নামে তিনটি শহরের গোড়াপত্তন করেন খানজাহান। এর পর তিনি আসেন লবণাক্ত অঞ্চল খলিফাতাবাদে। এখানে আসার পর সর্বশেষ রনবিজয়পুর এলাকায় মগ এবং জলদস্যুদের সাথে যুদ্ধ করে তিনি বিজয় অর্জন করেন।
স্থানীয় মুসল্লিরা জানান, বাগেরহাট ষাটগম্বুজ মসজিদে ঈদের বৃহৎ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এক সাথে প্রায় তিন হাজার মুসল্লি এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন। নারীদের নামাজের জন্যও আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে ষাটগম্বুজে।