তুরস্ক ও সিরিয়ায় আঘাত হানা বিপর্যয়কারী ভূমিকম্পের চার দিন পরও শুক্রবার ধ্বংসস্তূপ থেকে এক ডজনেরও বেশি জীবিত মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। তীব্র ঠাণ্ডা, ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও গুরুতর আহত হওয়ার পরও এই মানুষদের জীবিত উদ্ধার করতে পেরে উদ্ধারকারীরাও আনন্দ উল্লাস করেছেন এবং আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করেছেন।
গত সোমবারের ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় কয়েক হাজার বিল্ডিং ধসে পড়েছে। এতে কমপক্ষে ২৪ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, কমপক্ষে ৮০ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন এবং কয়েক লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
একজন উদ্ধারকর্মী বলেছেন, কিলিঙ্ক ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা মানুষদের সঙ্গে ক্রু সদস্যরা মজা করছিল, এর মাধ্যমে তারা আহতদের মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করছিল।
উদ্ধারকারীরা ভূমিকম্পের উৎপত্তির কেন্দ্রের সবচেয়ে কাছের শহর কাহরামানমারাসে উদ্ধারের পর প্রতিটি মানুষকে আলিঙ্গন করছিলেন এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলেন।
হ্যাবারতুর্ক টেলিভিশন এক প্রতিবেদনে জানায়, আদিয়ামানে মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
৪ বছর বয়সী ইয়াগিজ কমসুকে ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করার পর উদ্ধারকারী ও আশেপাশের মানুষ উল্লাস করে।
আরও পড়ুন: তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা সাড়ে ২০ হাজার ছাড়িয়েছে
উদ্ধারকারীরা ইয়াগিজকে একটি জেলি বিন দেয় এবং এরপর তারা তার ২৭ বছর বয়সী মা আইফার কমসুকে উদ্ধার করে।
১৩ দশমিক ৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের আবাসস্থল এই ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই জাপানের ফুকুশিমা ভূমিকম্প ও সুনামির চেয়ে বেশি লোক মারা গেছে। আরও অনেক লাশ উদ্ধার করা এবং গণনা করা বাকি রয়েছে।
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছে তুরস্কের শহর গাজিয়ানটেপের একটি বেসমেন্ট থেকে উদ্ধারকারীরা ১৭ বছর বয়সী আদনান মুহাম্মাদ কোরকুটকে উদ্ধারের পর আত্মীয়রা কান্নাকাটি করে।
আদনান ৯৪ ঘন্টা ধরে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে ছিলেন এবং বেঁচে থাকার জন্য নিজের প্রস্রাব পান করতে বাধ্য হয়।
সে উদ্ধারকারীদের বলে, ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ আপনারা এসেছেন।’
হ্যাবারতুর্ক টেলিভিশন বলেছে, উদ্ধারকারীরা ইস্কেন্দারুনের একটি উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের ধ্বংসাবশেষের ভিতরে আটকে পড়া ৯ জনকে শনাক্ত করেছে এবং তাদের মধ্যে ছয়জনকে টেনে বের করেছে, যার মধ্যে একজন নারীও রয়েছে। বের করে আনার পর যখন তাকে স্ট্রেচারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আশেপাশের মানুষেরা চিৎকার করে বলেন ‘আলালাহু আকবর!’
এই ভবনটি ভূমধ্যসাগর থেকে মাত্র ৬০০ ফুট (২০০ মিটার) দূরে ছিল।
কাহরামানমারাসের আরেকটি উদ্ধার প্রচেষ্টার ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন জরুরি কর্মী তার স্মার্টফোনে একটি পপ গান বাজিয়ে দুই কিশোরী বোনকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছিলেন, যখন তারা মুক্তি পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল।
একটি জার্মান দল বলেছে যে তারা কিরিখানের একটি ধসে পড়া বাড়ি থেকে একজন মহিলাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। তারা ৫০ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে উদ্ধার কাজ করেছেন।
আরও পড়ুন: একটু উষ্ণতার জন্য লড়ছে তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া মানুষেরা
হ্যাবারটার্ক টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভিডিওতে একজন আটকে পড়া নারীকে একটি দলের সঙ্গে কথা বলতে শোনা যায়।
তিনি উদ্ধারকারীদের বলেছিলেন যে তিনি বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে আটকে পড়া ব্যক্তিরা এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় বাঁচতে পারে, তবে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দ্রুত কমে আসছে।
মর্গ ও কবরস্থানগুলো লাশে ভরে উঠেছে এবং কিছু শহরটির রাস্তায় কম্বল, পাটি ও কাপড়ে মোড়ানো লাশ পড়েছিল।
তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেছে এবং অনেক লোকের কোন আশ্রয় নেই।
তুর্কি সরকার লাখ লাখ গরম খাবার এবং তাঁবু ও কম্বল বিতরণ করেছে। তবে এখনও অনেক অভাবী মানুষ সাহায্যের জন্য লড়াই করছে।
দুর্যোগ সিরিয়ার ১২ বছরের গৃহযুদ্ধের দ্বারা বেষ্টিত অঞ্চলটিতে দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। গৃহযুদ্ধ দেশের কয়েক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং তাদেরকে মানবিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল করে রেখেছে। যুদ্ধের ফলে আরও লক্ষাধিক মানুষ তুরস্কে আশ্রয়ের খোঁজে পাড়ি জমায়।
জাতিসংঘ বলেছে যে প্রথম ভূমিকম্প-সম্পর্কিত ত্রাণবাহী জাহাজটি শুক্রবার তুরস্ক থেকে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় প্রবেশ করেছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা অনুমান করেছে যে সিরিয়ায় প্রায় ৫ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হয়েছে।
ইউএনএইচসিআর-এর সিরিয়ার কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ শিভাঙ্কা ধানপালা শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, তারা তাঁবু, প্লাস্টিকের চাদর, কম্বল, ঘুমানোর ম্যাট এবং শীতের পোশাক সরবরাহের দিকে মনোনিবেশ করছে।
সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদ ও তার স্ত্রী আসমা আলেপ্পো ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে জীবিতদের দেখতে যান। দুর্যোগের পর এটি ছিল দেশের কোনো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নেতার প্রথম প্রকাশ্য উপস্থিতি।
আরও পড়ুন: ভূমিকম্প: তুরস্ক, সিরিয়ায় নিহত ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে
এরপর তিনি শহরের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধারকারীদের পরিদর্শন করেন।
আলেপ্পো বছরের পর বছর ভারী বোমাবর্ষণ ও গোলাবর্ষণে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এবং এবারের ভূমিকম্পে সবচেয়ে বিধ্বস্ত শহরগুলোর মধ্যে এটি একটি।
সিরিয়া সরকারও ঘোষণা করেছে যে তারা উত্তর-পশ্চিমে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দখলে থাকা এলাকাগুলো সহ দেশের সমস্ত অংশে সাহায্য পৌঁছানোর অনুমতি দেবে।
এছাড়াও শুক্রবার, নিষিদ্ধ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু এলাকায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে।
তুরস্কের দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা সংস্থা বলেছে যে তুরস্কে এই দুর্যোগে এ পর্যন্ত ২০ হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং ৮০ হাজার মানুষেরও বেশি আহত হয়েছে।
সিরিয়ায় ৩ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে, যার ফলে মোট মৃতের সংখ্যা প্রায় ২৪ হাজারে পৌঁছেছে।
তুরস্কের পরিবেশ ও নগর পরিকল্পনা মন্ত্রী মুরাত কুরুমের মতে, তুরস্কের প্রায় ১২ হাজারটি ভবন ধসে পড়েছে বা গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতায় বলেছেন, ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।