বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্বের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আস্থা বাড়ানোর জন্য জি২০ গ্রুপের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নতি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সামনে আসা সমস্যা মোকাবিলায় পুনরায় মনোযোগ দেওয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির নেতারা একত্রে কাজ করার উপায় খুঁজে বের করবেন এবং বিশ্ব যেসব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে, সেগুলো মোকাবিলা করার বিষয়ে ঐকমত্য হবে।
বহুপাক্ষিকতা রক্ষা করা
নয়দিল্লিরি জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির সেন্টার অব চাইনিজ অ্যান্ড সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের চেয়ারপার্সন বি.আর. দীপক বলেছেন, বর্তমান বিশ্বের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থায় বহুপাক্ষিকতার অভাব।
তিনি বলেন, ‘কিছু দেশ; বিশেষ করে পশ্চিমের দেশগুলো সুরক্ষাবাদ, নিজ দেশের বাসিন্দাদের স্বার্থ রক্ষার নীতি ও একচেটিয়া প্রভাবের নীতিগুলো মেনে চলছে এবং সম্ভবত উন্নয়নশীল দেশগুলো যে ধরনের বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস করে, তারা তাতে বিশ্বাস করে না।’
তিনি আরও বলেন, বহুপাক্ষিকতা হলো জি২০ এর মূল এজেন্ডাগুলোর মধ্যে একটি। আশা করছি গ্রুপটি শক্তিশালী বহুপাক্ষিকতার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশ্বকে একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠাবে।
১৯৯৯ সালে গঠিত হওয়া জি২০ হলো আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার একটি শীর্ষস্থানীয় ফোরাম।
এটি ১৯টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নিয়ে গঠিত। যা বিশ্বব্যাপী জিডিপির প্রায় ৮৫ শতাংশ, বিশ্ব বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশের বেশি এবং বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের প্রতিনিধিত্ব করে।
২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের পটভূমিতে জি২০ অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের বৈঠকগুলো আরও ভালোভাবে সংকট সমন্বয়ের জন্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের স্তরে উন্নীত করা হয়েছিল। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৭টি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এই বছরের শীর্ষ সম্মেলনের থিম- ‘ওয়ান আর্থ, ওয়ান ফ্যামিলি, ওয়ান ফিউচার’ (এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ)।
এবারের সম্মেলনে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, ডিজিটাল উদ্ভাবন, জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা এবং ন্যায়সঙ্গত বিশ্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা।
বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ভারতে জি-২০ সম্মেলনে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে অগ্রগতি প্রয়োজন।
অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলোর জন্য একটি অভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে ইনু বলেন, যদিও জি২০ সদস্যদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে, তবে সাধারণ কিছু বিষয়ে অগ্রগতির জন্য এক হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ওই আইনপ্রণেতা বলেন, অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর উপর রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর প্রভাব পড়া উচিত না। অনেকগুলো দেশের উপর আরোপিত বাণিজ্য বিধিনিষেধ, বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলকে বাধাগ্রস্ত করছে।
অর্থনীতি ও উন্নয়ন অবশ্যই আলোচনা মূল কেন্দ্রে থাকবে
ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতি, আর্থিক অস্থিরতা, গভীরতর ভূ-অর্থনৈতিক বিভাজন এবং উদীয়মান অর্থনীতি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঋণের চাপ বৃদ্ধিসহ একাধিক চ্যালেঞ্জ বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির উপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক আপডেট অনুসারে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২০২২ সালের আনুমানিক ৩ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ৩ শতাংশে নেমে যাওয়ার অনুমান করা হচ্ছে।
ইনু বলেন, বিশ্বের প্রধান উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির প্রতিনিধিত্বকারী একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম হিসেবে, জি২০-কে টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ এজেন্ডার লক্ষ্য অর্জনের জন্য নর্থ-সাউথ সহযোগিতার প্রসার করতে হবে।
দীপকের দৃষ্টিতে, গ্লোবাল সাউথের বর্তমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমস্যাগুলোকে কার্যকর অর্থায়ন এবং প্রযুক্তির সহায়তায় সমাধান করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা সম্ভবত আরও সহযোগিতা দেখতে পাব। গ্লোবাল নর্থ থেকে এই দেশগুলোতে প্রযুক্তি স্থানান্তরসহ নীতি ও তহবিলের আরও সমন্বয় দেখতে পাব।’
দ্য অস্ট্রেলিয়া ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক ও নিরাপত্তাবিষয়ক প্রোগ্রামের পরিচালক অ্যালান বেহম বলেছেন, বিশ্ব শাসনে জি২০ সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বেহম বলেন, ‘এই দেশগুলো মানুষের অগ্রগতিতে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। তাদের অর্থনীতির প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের অর্থনীতিও প্রসারিত হয়।’
চীনের সক্রিয় ভূমিকা
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং বৃহত্তম উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চীন বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোর উন্নয়নে জি২০’র অগ্রণী ভূমিকাকে সমর্থন করে এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির আহ্বান জানায়।
ইনুর মতে, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (ইউএমএফ) মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠস্বর দুর্বল।
তিনি জি২০-এ আফ্রিকান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তির জন্য চীনের সমর্থনেরও প্রশংসা করেন।
ইনু বলেন, ‘চীন জি২০ এর মধ্যে এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে এবং গ্লোবাল সাউথের স্বার্থের উন্নয়ন ঘটাতে পারে।’
ইন্দোনেশিয়ার পদজাদজারান ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সহযোগী অধ্যাপক তেকু রেজাসিয়াহ আশা করেন, চীন অবকাঠামো, গবেষণা ও উন্নয়ন, ওষুধ, নবায়ণযোগ্য জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়নে তার সুবিধাগুলো ব্যবহার করে বর্তমান গ্লোবাল সাউথ সহযোগিতার শূন্যতা পূরণের জন্য বিভিন্ন কর্মকাণ্ড প্রচার করবে।
ইনু বলেন, চীন বিভিন্ন বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলায় সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছে।
তিনি বিশ্বাস করেন, চীন এই বছরের জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে ‘খুব ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে’।