ভারতের সিকিমে বরফ গলা পানিতে সৃষ্ট বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৭ জনে পৌঁছেছে। রবিবার (৮ অক্টোবর) দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উদ্ধারকারীরা শনিবার আরও ছয়টি লাশ উদ্ধার করেছে। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭ জনে। এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১৫০ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
হিমালয়ের উত্তর-পূর্ব অংশের সিকিমে একটি বাঁধ ভেঙে হিমবাহী হ্রদের পানি উপচে উপত্যকায় পড়ে। বুধবার মধ্যরাতের পর বরফগলা পানির বন্যায় উপত্যকার মানুষের ঘরবাড়ি ও সেতু ভেসে যায় এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যূত হয়।
পুলিশ বলেছে, বরফগলা পানি নিচের উপত্যকার শহরগুলোতে আছড়ে পড়ে এবং বহু মানুষ নিহত হয়। কিছু লাশ ভেসে প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে লাশগুলো উদ্ধার করা হয়েছে।
জুন থেকে সেপ্টেম্বর বর্ষা মৌসুমে ভারতের হিমালয় অঞ্চলে ভূমিধস ও বন্যার কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এ অঞ্চলের হিমবাহ গলে আরও ঘন ঘন এ ধরনের দুর্যোগ আঘাত হানছে।
পুলিশ জানায়, রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের লাচুং ও লাচেন নামক দুটি স্থানে প্রায় চার হাজার পর্যটক আটকা পড়েছে। যেখানে বন্যার কারণে রাস্তাগুলো ভেসে যাওয়ায় তাদের উদ্ধার করা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে, খারাপ আবহাওয়ার কারণে উদ্ধার প্রচেষ্টা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে।
কর্তৃপক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আটকে পড়াদের সহায়তার জন্য হেলিকপ্টার মোতায়েন করতে পারেনি।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রেম সিং তামাং শনিবার বলেছেন, রাজ্যের স্থাপিত ২৬টি ত্রাণ শিবিরে বর্তমানে প্রায় ৩৯০০ জন মানুষ রয়েছেন।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, নিখোঁজ ২৩ জন ভারতীয় সেনার মধ্যে একজনকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং আটজন মারা গেছে।
তিনি আরও বলেন, নিখোঁজদের সন্ধানে অনুসন্ধান অভিযান চলছে। পার্বত্য সিকিম রাজ্যে কী কারণে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়, অস্বাভাবিকভাবে ভারী বর্ষার কারণে গত এক বছরে উত্তর-পূর্ব ভারতে বেশ কয়েকটি বন্যা হয়েছে।
নিকটবর্তী হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে গত আগস্টে আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসে কমপক্ষে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এর আগে গত জুলাই মাসে রেকর্ড বৃষ্টিতে উত্তর ভারতে দুই সপ্তাহে ১০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বুধবারের বন্যার সম্ভাব্য কারণে হিসেবে মঙ্গলবার বিকালে পাশ্ববর্তী নেপালে হওয়া তীব্র বৃষ্টি ও আঘাত হানা একটি ৬ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
কিন্তু এই বন্যা দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় পরিবেশকর্মীদের করা প্রতিবাদের আগুনে ঘি ঢেলেছে।
স্থানীয় পরিবেশকর্মীদের দাবি, হিমালয়ের চারপাশের বাঁধগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক।
অন্যদিকে, কর্তৃপক্ষ এ সংক্রান্ত একটি জাতীয় সবুজ জ্বালানি নীতি অনুসরণ করছে।
ছয় বছর আগে নির্মিত সিকিম রাজ্যের বৃহত্তম তিস্তা ৩ বাঁধের নকশা ও স্থাপনা নির্মাণের সময় থেকেই বিতর্কিত ছিল।
২০১৯ সালে সিকিম স্টেট ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটির সংকলিত একটি রিপোর্টে, লোনাক হ্রদকে বন্যার জন্য ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যা বাঁধ ভেঙে জীবন ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে।
চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণে ঘন ঘন বিপর্যয়ের কারণে বাঁধে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, ভারতীয় ফেডারেল সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদন দ্বিগুণ করার অর্থাৎ, ৭০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
শুক্রবার কর্মকর্তারা বলেছেন, লাচেন উপত্যকার ১১টি সেতু বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। যা পাইপলাইনেও আঘাত হেনেছে এবং চারটি জেলার ২৭০টিরও বেশি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করেছে।
রাজ্যের শিক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, তিস্তা অববাহিকায় ডিকচু ও রংপোসহ বেশ কয়েকটি শহর বন্যায় প্লাবিত হয়েছে এবং চারটি জেলার স্কুল রবিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্রকাশিত ছবি অনুসারে, বন্যা বেশ কয়েকটি সেনা ক্যাম্পেও আঘাত হেনেছে।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণ করা না হলে হিমালয়ের হিমবাহগুলোর আয়তন ৮০ শতাংশ কমতে পারে।
গত মাসে ঝড় ড্যানিয়েলের আঘাতে বাঁধ ভেঙে লিবিয়ার দেরনা শহরে বিধ্বংসী বন্যা হয়েছে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে উত্তর ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে আকস্মিক বন্যায় প্রায় ২০০ মানুষ মারা যায় এবং ঘরবাড়ি ভেসে যায়।