চাঁদাবাজি, প্রতারণামূলক অনলাইন কার্যক্রমসহ অনিরাপদ পরিবেশের কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা ও বিনিয়োগে আস্থা হারিয়ে ফেলছেন বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে উদ্যোক্তাদের অনিরাপদ পরিবেশ, চাঁদাবাজি, প্রতারণামূলক অনলাইন কার্যক্রম, পণ্য পরিবহন ঝুঁকি, জালিয়াতি প্রভৃতি প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়।’
বুধবার (২১ মে) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণে উন্নত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখার অত্যাবশকীয়তা শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন তিনি।
তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘নির্বিঘ্নে, স্বচ্ছভাবে ও নিরাপত্তার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনার একটি সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’
ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়নে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন আছে উল্লেখ করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতার লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। দাবি আদায় গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের অংশ হলেও, অর্থনীতির এ কঠিন সন্ধিক্ষণে ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি জনগনের দৈনন্দিন কার্যক্রম যেন ব্যাহত না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান ডিসিসিআই সভাপতি।
এছাড়াও রাজধানী ঢাকার উপর চাপ কমাতে প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি, যার মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের উন্নয়ন আরও সুসংহত হবে বলে জানান তিনি।
ডিসিসিআই’র সাবেক ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি আলহাজ্ব আব্দুস সালাম বলেছেন, ‘ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে আমরা চিন্তিত। ব্যবসায়ীরা নিয়মিত ভ্যাট-ট্যাক্স দিলেও বর্তমানে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে হচ্ছে, যা মোটেও কাম্য নয়।’
ডিসিসিআই’র প্রাক্তন সহসভাপতি এম আবু হোরায়রাহ ঢাকা দক্ষিণ এলাকায় পার্কিং সুবিধা বাড়নোর পাশাপাশি দক্ষিণের ট্রাফিক বিভাগের অফিস শান্তিনগর থেকে গুলিস্তানে স্থানান্তরের সুপারিশ করেন। তিনি বৈদ্যুতিক ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোকে ঢাকা শহরের বাইরে স্থানান্তর করারও সুপারিশ করেন। পাশাপাশি অতিদ্রুত ঢাকা শহরের পরিবহনের কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নেরও দাবি জানান।
বাংলাদেশ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মওলা বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থতির পট পরিবর্তনের পর আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নয়ন হয়নি।
তিনি বলেন, ‘স্থলবন্দরের মাধ্যমে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে দালালের মাধ্যমে ট্রাক ভাড়া করতে গিয়ে ব্যবসায় ব্যয় বাড়ছে। মৌলভীবাজার এলাকায় অনিয়ন্ত্রিত ট্রাকস্ট্যান্ড থাকায় বাবুবাজার ব্রিজে প্রচন্ড যানজট হচ্ছে, ফলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।’
এ ছাড়াও, লালবাগ, কোতোয়ালি, চকবাজার এলাকার ব্যবসায়ীদের নগদ টাকা পরিবহনে নিরাপত্তার স্বার্থে এসব এলাকায় সান্ধ্যকালীন পুলিশি টহল বাড়ানো দাবি জানান এ ব্যবসায়ী নেতা।
বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী আবুল হাসেম বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হলেও চিনির উপর সরকারের অতিরিক্ত ট্যাক্স আরোপের ফলে চিনির মূল্য যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ব্যবসায়ীদের ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট। এ সময়, সরকারের কাছে ট্যাক্স কমানোর দাবি জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের ১৪টি চিনিকল থাকলেও উৎপাদিত চিনি দিয়ে মোট চাহিদার মাত্র ২ শতাংশ মেটানো যায়। এছাড়া, বেসরকারি খাতে চিনিকল আছে মাত্র ৩টি। এ খাতের পাইলট প্রকল্পের আওতায় সরকারের অন্তত ২টি চিনিকল সারা বছর চালানো উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া চিনি আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে সুষম প্রতিযোগিতার পাশাপাশি সাপ্লাইচেইন বৃদ্ধি করা গেলে চিনির দাম কমবে বলে জানান চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী সৈয়দ মোহাম্মদ বশির উদ্দিন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে পুলিশ বাহিনী এখনও সক্রিয় ভূমিকা রাখছে না। চিনি ও ভোজ্যতেল আমদানি সবার জন্য উন্মুক্ত করলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে, অবৈধ মজুদদারী বন্ধ হবে ও পণ্যের দাম কমবে।
বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি নেসার উদ্দিন খান বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের নৈরাজ্যে এখন জনজীবনের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, যা প্রতিরোধে পুলিশ প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ দরকার।
বাংলাদেশ মনিহারী বণিক সমিতির সহসভাপতি হাজী ফয়েজউদ্দিন বলেন, পুরান ঢাকায় প্রবেশপথগুলো বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচির কারণে বন্ধ থাকায় চকবাজারসহ অন্যান্য জায়গায় পণ্যবাহী ট্রাক যেতে পারছে না। ফলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হলেও চকবাজার, মৌলভীবাজার এলাকায় কোন ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় প্রতিনিয়ত যানজট অসহনীয় হয়ে পড়ছে, যা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।
এছাড়া পণ্য আমদানিতে শুল্কের হার বৃদ্ধি, ব্যাংকের ঋণের শর্ত পূরণ করতে না পারায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঋণ সুবিধা হতে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে জানান তিনি।
মোহাম্মদপুর টাউনহল কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি লুৎফুর রহমান বাবু বলেন, মোহাম্মদপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। এক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
এছাড়াও মোহাম্মদপুর এলাকায় ফুটপাতে অবৈধ দখল উচ্ছেদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি।
ধামরাই ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, ঢাকা শহরের আশপাশে ৩৭০টি ইটভাটা থাকলেও, সরকার ইট ভাটার লাইসেন্স নবায়নের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এ খাতের উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই বিষয়টির দ্রুত সুরাহার দাবি জানান তিনি।
পুলিশের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) মো. মোহাইমেনুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের পর বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এটি আরও উন্নতি করতে হবে। তবে এখনও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য উপযুক্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করা যায়নি।’
সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে দাবি তার। এছাড়া, কিশোর ও যুবক গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে পুলিশ বরাবরের মতো কঠোর এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
মত বিনিময় সভায় ডিসিসিআই’র ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী, সহ-সভাপতি মো. সালিম সোলায়মান ও পরিচালনা পর্ষদের অন্যান্য সদস্যসহ বেসরকারিখাতের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।