গত সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৮ ঘণ্টা সফরে দিল্লি এসেছিলেন। ভারতে হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে তার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। যেখানে প্রতিরক্ষা থেকে সীমান্ত সংযোগ, সন্ত্রাস মোকাবিলা থেকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যৌথ অংশীদারি ইত্যাদি সবই ছিল। ভারত সরকারের সঙ্গে তিনি ১০টি চুক্তি করে গেছেন। সেই চুক্তিতে শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ ১৬ আনা নয়, ১৮ আনাই সফল হয়েছেন।
ভারতে যারা এখনও বাংলাদেশ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন, তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার হাসিনার ভারত সফর প্রসঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের মতে, এসব চুক্তি বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে হাসিনা ঢাকা ফিরে গিয়ে আওয়ামী লীগের ৭৫ বছর পূর্তি উৎসব পালন করেছেন। সেখানেও যা খবর পাওয়া গেছে, তার দেশ এই চুক্তির মধ্যে যথেষ্ট আশার আলো দেখতে পাচ্ছে।
এসব দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মূল বিষয়ের দিকে এবারে চোখ ফেরানো যাক: বাংলাদেশের অসুস্থদের জন্য ই ভিসা, রাজশাহী-কলকাতা নতুন রেল সংযোগ, চট্টগ্রাম-কলকাতা নতুন বাস সংযোগ, গেদে থেকে দলগাঁও মালবাহী রেল সংযোগ, রংপুরে নতুন সরকারি হাইকমিশন, ভারতীয় গ্রিডের মাধ্যমে নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ, সিরাজগঞ্জে ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো তৈরি করা, গঙ্গা চুক্তি নবীকরণে যৌথ কারিগরি দল, যৌথ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় উদ্যোগ এবং তিস্তা সংরক্ষণ ও পরিচালন প্রকল্পের জন্য ভারতীয় বিশেষজ্ঞ দলের বাংলাদেশ সফর।
এই নতুন সমঝোতা পত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তিস্তা সংক্রান্ত পদক্ষেপ। কারণ, ধাক্কা খেয়েছে চীন। ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক দলের মুখ্যমন্ত্রী মমতাও জোর ধাক্কা খেয়েছেন। এই খবর প্রকাশিত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি করেছেন ফারাক্কা চুক্তি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে কৈফিয়তও দাবি করেছেন।
২৮ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বাবুর সঙ্গে কথা বলে ৩০ বছরের চুক্তি হয়েছিল, যা শেষ হবে ২০২৬ সালে। ওই চুক্তি হয়েছিল জাতিপুঞ্জের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন জ্যোতি বসু এবং কংগ্রেস নেতা বরকত গনি খান চৌধুরী। এই ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর খুনি জিয়াউর রহমান ভারতের বিরুদ্ধে জাতিপুঞ্জে নালিশ জানিয়েছিলেন। সেই নালিশের জবাব দিতে ইন্দিরা গান্ধী জাতিপুঞ্জে পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ ও সেচমন্ত্রী মালদার গনি খান চৌধুরীকে। বরকত সাহেব নিউইয়র্কে জাতিপুঞ্জে অন্তত ৫০টা দেশের সঙ্গে কথা বলে বুঝিয়েছিলেন যে বাংলাদেশকে মাত্র ৪ বছর হল আমরাই স্বাধীন করে দিয়েছি, হঠাৎ পানির জন্য এখানে কেন?
তিনি আরও বলেন, ‘রক্ত দিয়েছি, পানিও দেব, কিন্তু এখানে নয়। বাংলাদেশকে আসতে হবে ঢাকা, দিল্লি, কলকাতা ও মালদায়।’ জাতিপুঞ্জের প্রেস গ্যালারিতে তখন আমিও বসেছিলাম।
হঠাৎ ৩০ বছর পরে মমতা কেন তিস্তা নিয়ে রাজনীতি করতে চাইছেন? তিনি ভুলে গেছেন যে তিনি একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, দেশের প্রধানমন্ত্রী নন। তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফরের আগে তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননকে তিন তিন বার কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন মমতার সঙ্গে কথা বলতে। শেষবারে মেনন তারই ব্যাচমেট মুখ্যসচিব প্রসাদ রায়কে মমতার সামনে বলে এলেন যে আপনি দয়া করে আপনার মুখ্যমন্ত্রীকে ইংরেজি শেখান, উনি জানেন না, তাই আমার কোনো কথাই উনি বুঝতে পারছেন না।
এবারে দেখা যাক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সাফল্য। হাসিনার সফর নিয়ে আমি বিদেশমন্ত্রকের অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের সঙ্গে কথা বলেছি। কথা বলেছি মনমোহন সিংয়ের আমলে প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেননের সঙ্গেও।
তিনিও বলেছেন- এই চুক্তি হাসিনার অভিজ্ঞতা ও পরিণতমনস্কতা প্রমাণ করে। আশা করি বাংলাদেশের মানুষও এতে খুশি হবেন। শোনা গিয়েছিল সুখা মরসুমে জল ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ তিস্তার উপরে একটি বাঁধ তৈরি করবেন যার খরচ হবে ১ বিলিয়ন ডলার। এই টাকাটা অল্প সুদে ভারত বাংলাদেশকে দেবে। চীন এই সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। ভারত সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছে। অভিযোগের পরে অভিযোগ ছিল যে চীন আওয়ামী লীগের কিছু নেতার মাধ্যমে তদবির শুরু করেছিল।
বাংলাদেশের উত্তর খণ্ডের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ভারতীয় ভিসা অফিস খোলা, এই চুক্তিতে তাও অনুমোদিত হয়েছে। দুই দেশের পর্যটন ব্যবসা বৃদ্ধিতে এই চুক্তি অনেকটাই কার্যকরী হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহল, তবে তা নির্ভর করছে দুই দেশের ভিসা সংক্রান্ত নিয়মের শিথিলতার ওপর।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মতে, গত এক বছরের মধ্যে এবারের বৈঠকটি ছিল একেবারেই আলাদা। কারণ তৃতীয় বার তারা সরকার গঠন করার পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীই আমাদের প্রথম রাষ্ট্রীয় অতিথি। হাসিনা মনে করেন, দু’দেশের সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই ঢাকা-দিল্লি নতুনভাবে পথ চলা শুরু করেছে।
ভারত বাংলাদেশ চুক্তির ১০টি বিষয়ই দু’দেশের অনেক সমস্যার সমাধান করবে। এ বিষয়ে ভারতের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের কোনো দ্বিমত নেই। তারা সবাই খুশি।
লেখক: মিডনাইট মেসাকার গ্রন্থের লেখক, প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
(বি.দ্র. ইউএনবির সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামত নাও মিলতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো দায়ভার ইউএনবি নেবে না।)