উচ্ছল মুক্ত বিহঙ্গ, বাংলার উড়ন্ত মানবী অথবা আগুন ডানার পাখি! রাজু ভাস্কর্যের সামনে নৃত্যরত মেয়েটিকে এমনি নামে ডাকছেন বাংলাদেশের নেটিজেনরা। ইউরোপের নাচ ব্যালের নৃত্যকলায় তার ভাসমান ভঙ্গিমার আলোকচিত্র যেন নারীমুক্তি স্লোগান দিয়ে চলেছে। প্ল্যাকার্ড-পোস্টার পটভূমিতে রেখে মুক্তির ঐকতানে বেজে চলেছে তার স্বতঃস্ফূর্ত নাচের মুদ্রাগুলো। একই সাথে জানান দিচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির রক্ষণশীল প্রাঙ্গণে নতুন শিল্পকর্মের পদচিহ্নের। জয়িতার আলোকচিত্রকর্মে ইরা নামের মেয়েটির সপ্রতিভ পরিবেশনা এভাবেই জায়গা করে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাম্প্রতিক বহুল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। চলুন, জেনে নেয়া যাক এই ইরা ও জয়িতার ব্যাপারে।
ব্যালে বালিকা ইরা’র পরিচয়
নওগাঁ জেলার জগত্সিংহপুর মহল্লার বটতলা নিবাসী ব্যালে বালিকা মুবাশশিরা কামাল ইরা। বাবা আবু হায়াৎ মোহাম্মদ কামাল একজন ব্যবসায়ী আর মা ফাহমিদা আক্তার একজন গৃহিণী। চার বোনের মধ্যে ইরা তৃতীয়।
মেধাবী ছাত্রী ইরা ২০২০ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে শেষ করেন মাধ্যমিকের পাঠ। স্কুল ছিলো নওগাঁ সীমান্ত পাবলিক স্কুল। বর্তমানে তিনি নওগাঁ সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষে বাণিজ্য শাখায় অধ্যয়নরত আছেন।
আরও পড়ুন: শিক্ষা সনদপত্র হারিয়ে গেলে করণীয়
ইরার ব্যালে নাচের নেপথ্যের কথা
এই খ্যাতির শুরুটা হয় আলোকচিত্রী জয়িতার সাথে ইরার পরিচয়ের মধ্য দিয়ে। গত ২০ থেকে ২২ জানুয়ারিতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত নৃত্য উৎসবে যোগ দিতে ঢাকায় আসেন ইরা। তখনই দুজনের মাঝে দেশের ভেতর নতুন ধারার ফটোগ্রাফি নিয়ে আলোচনা হয়। উদ্দেশ্য দেশীয় ঐতিহ্যকে সামনে রেখে ধরাবাধা সংস্কৃতির বাইরে যেয়ে নতুন কিছু করা।
২৩ জানুয়ারির সকালে টিএসসি চত্বর দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে রাজু ভাস্কর্য সংলগ্ন বিভিন্ন আন্দোলনের প্ল্যাকার্ড ও পোস্টার। সাথে সাথেই সেখানে কিছু ছবি তুলে নেন। ছবিগুলো ফেসবুকে প্রকাশ করেন ২৫ জানুয়ারি বিকাল ৪টায়। আর তারপরেই যাদুর মত ঘটতে শুরু সব ঘটনা। নিমেষেই ফেসবুক জুড়ে ছড়িয়ে যায় ছবিগুলো। রীতিমত তারকা বনে যান মুবাশশিরা কামাল ইরা।
ব্যালে নিয়ে লকডাউনের সময় থেকেই কাজ করছিলেন ইরা। ইতোমধ্যে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ থাকায় ছোট বেলা থেকেই নাচের প্রতি প্রচন্ড ভালো লাগা কাজ করতো তার।
অন্যদিকে জয়িতা একজন নতুন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার। তাই ২৫ জানুয়ারির তোলা সেই ছবিগুলো ইরা ও জয়িতা দুজনেরই প্রতিভা বিকাশের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার পরিচায়ক।
তাদের এই চেষ্টাকে আরও বহুগুণে ফলপ্রসু করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে সিলেটের শাবিপ্রবি (শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)-এর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ঘটনাটি।
আরও পড়ুন: পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে করণীয়
ইরা’র ব্যালে নাচের স্বপ্ন
মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ইরার নাচের হাতে খড়ি হয় শিক্ষক সুলতান মাহমুদের কাছে। সে সময় বেশ পোক্তভাবেই মুদ্রাগুলো শিখে নিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় ভরতনাট্যম শিখে ফেলেন। কিন্তু ব্যালে নৃত্যের দিকে তার দৃষ্টি পড়ে ২০২০ সালে, যখন সারা দেশ লকডাউনে জর্জরিত। বরাবর নতুন কিছু শেখার জন্য মরিয়া হয়ে থাকা ইরা তখনো থেমে থাকেননি। দেশে ব্যালের কোন শিক্ষক না থাকায় মায়ের কথায় ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজে নিজেই তালিম নিতে শুরু করেন। পরিবারের অন্যদের পক্ষ থেকে সমর্থন না থাকলেও ইরার মা সবসময় মেয়ের ইচ্ছা ও আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। ব্যালের জন্য বিশেষ ধরনের জুতার প্রয়োজন হয়, যেটা দেশের বাজারে পাওয়া যায় না। তাছাড়া খালি পায়ে পায়ের অগ্রভাগের উপর চাপ দিয়ে ব্যালে অনুশীলন করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এরপরেও সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব তাই দিয়েই কঠোরভাবে চেষ্টা করে যান ব্যালেকে আত্থস্ত করতে।
২০২১ সালে ঢাকায় প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী লুবনা মরিয়ম-এর নাচের প্রতিষ্ঠান 'সাধনা' তে যোগ দেয়ায় তার ব্যালের পারদর্শিতা আরো বহুগুনে বেড়ে যায়। তাছাড়া ছোট থেকে অ্যাথলেট হওয়ার কারণে শারীরিক উপযোগিতার ক্ষেত্রেও তিনি বেশ সুবিধা পেয়েছেন ব্যালে দখল নেওয়ার সময়।
প্রথমেই ব্যালে নাচে নিজের একটা জায়গা তৈরি করতে চান ইরা। নাচ নিয়ে পরবর্তীতে পড়াশোনা করারও ইচ্ছা আছে তার। তারপর দেশীয় নাচ ও ব্যালের সংমিশ্রণে বাংলাদেশের নৃত্যশিল্পে নতুন ধারা সংযুক্ত করতে চান ব্যালে বালিকা ইরা।
আরও পড়ুন: জন্ম নিবন্ধন করার নিয়ম: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, খরচ ও সময়
চিত্রগ্রহণে জয়িতা
ইরার এই পরিচিতির পেছনে যে মানুষটির অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হচ্ছেন আলোকচিত্রী জয়িতা। পুরো নাম জয়িতা আফরিন তৃষা। থাকেন ঢাকার ধানমন্ডিতে। ছবি তোলার জন্য রাজু ভাস্কর্যের জায়গাটি নির্বাচনসহ ফটোশ্যুটের বিভিন্ন আইডিয়াগুলো তারই মস্তিষ্ক প্রসূত। ছবিগুলোর মাধ্যমে তিনি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী প্রধান জায়গাগুলোর সাথে ব্যালে নৃত্যের সৌন্দর্য্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ছবি তোলা জয়িতার নেশা আর এটি নিয়েই তিনি তার ক্যারিয়ার সাজাতে চান। আকস্মিক জনপ্রিয়তা অপেক্ষা ভালো কাজ করে যাওয়ার প্রতিই তিনি অগ্রাধিকার দেন। ভালো কাজের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে চান তিনি। পাশাপাশি ইরা ও জয়িতা দুজনেরই চাওয়া যে তাদের কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশে নারীরা যেন বিশ্বমানের কাজে অংশ নিতে উৎসাহিত হয়।
পড়ুন: ট্রেড লাইসেন্স করার পদ্ধতি: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, খরচ ও সময়
পরিশেষে
ইউরোপের দেশ ফ্রান্সে উদ্ভুত এই জিমনেশিয়াম ও অভিনয়ের যুগপৎ অঙ্গভঙ্গিমার নাচ ব্যালেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত খুব একটা কাজ হয়নি বাংলাদেশে। সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্যতার দিকটিও এখানে উপলব্ধির ব্যাপার। কিন্তু ইরার মত আরো উদীয়মান তারকাদের বদৌলতে বাংলাদেশের সংস্কৃতি আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে এই বিদেশি নৃত্যকলাটিতে।