বছরান্তে সময়টা যতই পৌষ-মাঘের কাছাকাছি হতে শুরু করে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে অত্যধিক ঘুম ঘুম ভাব প্রবণতা। এরকম অনস্বীকার্য শীতের ক্লান্তিটা প্রায়ই কাজের রুটিনটাকে ওলোট-পালোট করে দেয়। কখনো মনে হতে পারে সারাদিন শারীরিক পরিশ্রম বা অতিরিক্ত কাজের জন্য হয়ত ঘুম ঘুম ভাবটা বেড়েছে। কিন্তু শীতের মৌসুমে ঘুমের এমন অদ্ভূত আচরণটা স্বাভাবিক। চলুন জেনে নেয়া যাক, কেন এরকমটা হয়, আর এ থেকে উত্তরণের উপায়ই বা কি।
শীতে যে কারণে বেশি ঘুম আসে
এক কথায় বলতে গেলে শীতকালে অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাবের মুল কারণ হলো সূর্যালোকের তুলনামুলক ভাবে কম উপস্থিতি। অর্থাৎ দিনের স্বল্পতা এবং রাত দীর্ঘ হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই শরীর প্রয়োজনের তুলনায় কম সূর্যালোক পেয়ে থাকে। এর প্রভাবেই শরীর ও মনে সৃষ্টি হয় নানা জটিলতা। সেগুলোর মধ্যে প্রধান তিনটি সমস্যা সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়।
১। নিদ্রা উদ্রেক হরমোনের নিয়ন্ত্রণহীনতা
মেলাটোনিন হরমোন শরীরকে ঘুমের দিকে ধাবিত করার জন্য মুল ভুমিকা পালন করে। শীতকালে প্রাকৃতিক আলোর অভাবে শরীরের অভ্যন্তরে অত্যধিক মেলাটোনিন তৈরি হয়। ফলস্বরূপ, মানবদেহের অভ্যন্তরীণ সার্কাডিয়ান ছন্দ বা ঘুম ও জেগে ওঠার চিরায়ত চক্রকে ব্যাহত হয়। গরমের সময়ে সূর্যালোকের উপস্থিতি মেলাটোনিন নিঃসরণের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই সে সময় ঘুম ঘুম ভাব থাকে না। বরং সার্কাডিয়ান ছন্দটি সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকে গরমের দিনগুলোতে।
পড়ুন: মধু কি সত্যি অমৃত?
২। শরীরে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি
ভিটামিন ডি এর ঘাটতি এবং নিদ্রাহীনতার মাঝে একটি লক্ষণীয় যোগসূত্র রয়েছে। অন্ধকার আকাশ এবং ঝাপসা আবহাওয়া এই পুষ্টির অপর্যাপ্ত মাত্রাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে। এটি শুধুমাত্র ঘুম ঘুম ভাব বাড়িয়ে তোলা নয়; শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মন-মেজাজের ওপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে।
৩। মানসিক অবসাদগ্রস্ততা
এসএডি (সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার) হলো একটি সাধারণ মানসিক অবস্থা, যা প্রায়ই শীতকালে দেখা দিয়ে থাকে। 'উইন্টার ব্লুজ' নামে পরিচিত এই অবস্থাটি মুলত প্রতি বছরের শীতনিদ্রা প্রবণতার প্রতিফলন হিসেবে ঘটে থাকে। এর কারণে প্রতি বছর শীত এলেই শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ঠান্ডা আবহাওয়া এবং সূর্যালোকের স্বল্পতা মস্তিষ্ক থেকে সেরোটোনিন হরমোন নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। এই হরমোনটি সুখের অনুভূতি উদ্দীপিত করে মেজাজ উন্নত রাখতে সাহায্য করে। শীতে এই হরমোনের ঘাটতি অবসাদগ্রস্ততার সৃষ্টি করে।
পড়ুন: নিপা ভাইরাস এড়িয়ে খেজুর রস খাওয়ার উপায়
শীতকালে অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব দূর করার উপায়
১। প্রতিদিন ভোরবেলা শরীরচর্চা করা
শীতে দিন ছোট হলেও যতটুকু পাওয়া যায় ততটুকুর সদ্ব্যবহার করা উচিত। বিশেষ করে ভিটামিন ডি-এর বিশাল উৎস ভোরের টাটকা সূর্যালোক কোন ভাবেই এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। নিত্য দিন কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার আগে কমপক্ষে এক ঘন্টা সূর্যালোকে শরীরচর্চা অথবা খেলাধুলা করা সারাদিনের জন্য শরীরটাকে সতেজ রাখতে পারে। এছাড়াও মধ্যাহ্নভোজের বিরতির সময় সূর্যালোকে হাটাহাটি করা যেতে পারে। এটি ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে অলসতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
২। পুষ্টিকর বিশেষত ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার খাওয়া
সুষম খাবার গ্রহণ সব ঋতুর জন্যই প্রযোজ্য। আর শীতের ঘুম ঘুম ভাব কাটানো জন্য শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন ডি-এর যোগান দিতে হবে। ডিমের কুসুম এবং মাশরুম ভিটামিন ডি-এর একটি ভালো উৎস। এছাড়া প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় গরুর দুধ ও মাংস বিশেষ করে কলিজা, সয়া দুধ, কমলার জুস ও পনির রাখা যেতে পারে। ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট খুব দ্রুত কাজ করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
পড়ুন: ঢাকার কোথায় ভালো পরিবেশে সাঁতার শেখা যায়
৩। ভ্রমণ করা
শীতকাল এমনিতে ভ্রমণের ঋতু হিসেবে জনপ্রিয়। আর এই ঘুমের রেশ কাটানোর জন্য দূরে কোথাও ভ্রমণে যাওয়া খুব ভালো একটা উপায় হতে পারে। সাইক্লিং, হাইকিং, রাফটিং, ও ম্যারাথন শীতের স্বল্প দিনে শরীরকে অনায়াসেই কর্মক্ষম এবং রোগমুক্ত রাখতে পারে।
এভাবে শীতের প্রকৃতিগত একঘেয়েমি সহ ঘুম ঘুম ভাব ও ক্লান্তি কাটানো যেতে পারে। যদিও শীতপ্রিয় মানুষেরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন এই সময়টির জন্য, তবে অতিরিক্ত শীত অনেকের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। তবে সঠিক রুটিন মেনে চলাটা বছরের যে কোন সময়েই শরীরকে ফিট রাখার জন্য সহায়ক হতে পারে।