আসন্ন পবিত্র ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে কুড়িগ্রাম জেলার হাটগুলোতে কোরবানির গরু-ছাগল বেচাকেনার ধুম পড়েছে । কুড়িগ্রাম জেলার সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয় এই তিন রাজ্যের সাথে সীমান্ত।
প্রশাসনের করা নজরদারি থাকায় এবার ভারত থেকে কোনো গরু সীমান্ত পাড়ি দিয়ে হাটগুলোতে নিয়ে আসতে পারেনি। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্রের বিশাল জলরাশি পার হয়ে প্রতিবছর ভারতীয় গরু আমদানী হলেও, এবছর আসেনি প্রতিবেশী দেশের গরু। যার ফলে দেশি খামারিদের মধ্যে স্বস্তি ও খুঁশির হাসি দেখা গেলেও ক্রেতারা পড়েছে মহাবিপাকে।
সরেজমিনে হাটে গিয়ে গিয়ে দেখা যায়, কুড়িগ্রাম সদরের দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদের মিলিত স্থানের পাশেই বিশাল এলাকা জুড়ে যাত্রাপুর হাট। এই হাটে বসে কোরবানির পশুর হাট। অর্থনৈতিক সংকটে থাকায় ক্রেতারা বড় গরুর চেয়ে ছোট গরুর দিকে ঝুঁকছেন বেশি।
আরও পড়ুন: সীতাকুণ্ডে গরুর বাজারে নজর কেড়েছে ‘কালা বাবু’
ক্রেতা বিক্রেতাদের হাঁকডাকে পশুর হাট সরগরম হয়ে উঠেছে। কাঁদা-গোবর পেরিয়ে লোকজন গরু দেখছেন। কিনছেন কম। বড় গরুর চেয়ে ছোট ও মাঝারি গরুর দাম সাধ্যের মধ্যে হওয়ায় খুব সহজে কিনছেন অনেকেই। এছাড়াও সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় প্রতিবছর কোরবানির সময় যাত্রাপুর হাটে চোরাই পথে ভারতীয় গরু উঠলেও এবারে ভারতীয় গরু না আসায় স্বস্তিতে আছেন প্রান্তিক কৃষক ও খামারিরা।
জেলা শহরের বাসিন্দা রকিবুল হাসান বলেন,' জেলার সব থেকে বড় হাট আমাদের এই যাত্রাপুর। এবার ভারতীয় গরু না থাকায় দেশি অনেক গরু উঠেছে। আশা করছি সাধ্যের মধ্যে পছন্দ মতো গরু কিনতে পারবো।'
হাটের ইজারাদাররা বলছেন, ভারতীয় গরু না আসায় এবার হাটে বাইরের জেলার ব্যাপারীর সংখ্যা কম। অন্যদিকে বন্যার পানি বাড়ার কারণে এবার হাটে চরাঞ্চলের অনেক গরু এসেছে। আর বিক্রেতার তুলনায় হাটে ক্রেতার সংখ্যাও কম নয়। যার কারণে অল্প লাভে খামারিরা গরু বিক্রি করছেন।
ব্রহ্মপুত্রের দ্বীপচর মোল্লারহাট থেকে দুটি গরু নিয়ে এসেছেন কৃষক ও গরু ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক। তিনি বলেন,' আমার মাঝারি দুইটা গরুর দাম প্রতিটি ৮০ থেকে ৯০ হাজার করে চাচ্ছি । বড় ব্যাপারী নাই। স্থানীয় লোকজন ৬০ থেকে ৬৫ হাজার দাম বলেছে। এই দামে বিক্রি করলে লাভ তো দুরের কথা অনেক লোকসানে পরব।
খেয়ার আলগার চরের কৃষক মোন্নাফ আলী বলেন, ‘সাড়ে তিন মণ ওজনের দুইটা ষাঁড় গরু ব্যাচবার(বিক্রি) আসছি । নৌকা ঘাটেই ৮৫ হাজার টাকা করে বিক্রি করলাম। ছোট গরু কেনার মানসের (মানুষের) অভাব নাই। হাটত আনার আগেই বিক্রি হয়া যায়। ভারতের গরু না আসায় হামরা খুব খুশি।’
নাগেশ্বরী মাদারগঞ্জ থেকে আসা খামারি জিয়াউর রহমান বলেন,'এবার ভারতের গরু নেই এটা খুশির খবর। কিন্তু ক্রেতা সংকট খারাপ দিক। আমার এই গরুটা ১ লাখ ১০ হাজার দাম চাচ্ছি। যাত্রাপুর হাটে এবার বড় গরুর তেমন চাহিদা দেখছি না। লোকজন বেশি মনে হলেও প্রকৃত ক্রেতা নাই।
যাত্রাপুর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন,'গত বছরের চেয়ে এবার হাটে দেশি ছোট ও মাঝারি গরুগুলোর দাম মানুষের সাধ্যের মধ্যে রয়েছে। বন্যার পানি উঠার কারণে চরের লোকজন বাড়িতে গরু না রেখে কম লাভে বিক্রি করে দিচ্ছে।
আরও পড়ুন: মানিকগঞ্জে পদ্মায় কোরবানির ২৮টি গরুবাহী ট্রলারডুবি
অন্যদিকে,যাত্রাপুর হাটে নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ইজারা আদায়। ঈদের হাট উপলক্ষে যাত্রাপুর হাটে ইজারা ২০০ টাকা করে অতিরিক্ত নেয়া হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত গরুর খাজনা ৫০০ টাকা এবং ছাগল-ভেড়ার ২৫০ টাকা। অথচ ক্রেতার কাছ থেকে গরুর খাজনা ৭০০ টাকা এবং ভেড়া-ছাগলের জন্য ৫০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। এছাড়াও বিক্রেতার কাছ থেকে আগে গরু প্রতি ২০০ টাকা নেওয়া হলেও ঈদ উপলক্ষে ৩০০ টাকা নেয়া হচ্ছে।
যাত্রাপুর হাট ইজারাদের অংশীদার মো. আমিনুল ইসলাম বলেন,'ঈদ উপলক্ষে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে খাজনা আদায় করা হচ্ছে। ঈদের পর থেকে এই অতিরিক্ত খাজনা আদায় হবে না।'
জেলা প্রানিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোশারফ হোসেন জানান, কুড়িগ্রামের সীমান্তগুলোতে বিজিবির কড়া নজরদারির কারণে যাত্রাপুর হাটে এবার ভারতীয় গরু আসতে পারেনি। ৯ উপজেলায় এ বছর কোরবানির জন্য ২ লাখ ৬৯ হাজার পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ১ লাখ বেশি।
কুড়িগ্রাম -২২, বিজিবি'র অধিনায়ক মো. আব্দুল মোত্তাকিম জানান, এবারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে ভারতীয় গরু অনুপ্রবেশ রোধের ক্ষেত্রে। তারই আলোকে আমরা ভারতীয় বিএসএফ'র সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে ইতোমধ্যে কিছু ভারতীয় গরু আটক করে নিলামের জন্য পাঠানো হয়েছে এবং আমাদের টহল টিম কঠোরভাবে নজরদারি করছে।
কুড়িগ্রাম পুলিশ সুপার আল আসাদ মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, স্বরাস্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ গরুর হাটে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সহ কোরবানির ঈদে চোরাচালান বন্ধে এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় পুলিশের সকল বিভাগ মাঠে কাজ করছে। আমি নিজেই নিরাপত্তার বিষয়টি মনিটরিং করছি।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরিফ জানান, কোরবানির ঈদের হাট উপলক্ষে যাত্রাপুর হাটসহ জেলার অন্যসব হাটগুলোতে জাল টাকা শনাক্তকরণে ব্যাংকগুলো মেশিন বসিয়েছে। এছাড়াও জেলা পুলিশ কঠোরভাবে নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছেন।
আর হাটে অতিরিক্ত টাকা ইজারা আদায়ের বিষয়টি আমার জানা নেই। নিয়মের বাইরে গিয়ে বেশি টাকা ইজারা আদায়ের কোন সুযোগও নেই। উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে অতিরিক্ত ইজারা বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আরও পড়ুন: গরুর হাটে জাল নোট শনাক্তে ব্যাংকগুলোকে বুথ বসাতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক