ময়মনসিংহ নগরীর ৩৩নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ চর কালিবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পান ৪০জন হিজরা। এদের প্রত্যেকেই মুসলমান। তারা এলাকার মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে নানা বাঁধার সম্মুখীন হন। এই পরিস্থিতিতে আলাদা একটি মসজিদ নির্মাণের কথা ভাবেন তারা।
এমন ভাবনা থেকে ময়মনসিংহে প্রথম হিজড়া জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে মসজিদ। এ নিয়ে এলাকায় বেশ আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হলেও বর্তমানে মসজিদে হিজড়াদের সঙ্গে নিয়মিত নামাজ পড়ছেন এলাকার মুসল্লিরাও।
নামাজ পড়া, মৃত্যুর পর জানাজাসহ নানা জটিলতা ও বাঁধার সম্মুখীন থেকেই সেতু বন্ধন হিজরা কল্যাণ সংঘের সদস্যরা মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। কিন্তু প্রয়োজন জায়গা ও অর্থের। তার কোনোটাই নেই তাদের। পরামর্শ করে দেখা করেন ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের কাছে। বিভাগীয় কমিশনারের সহযোগিতায় জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাছেই ৩৩ শতক জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়, সঙ্গে কিছু অনুদানও। রমজান মাসকে টার্গেট করে মসজিদের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করা হয়।
আরও পড়ুন: বেনাপোলে হিজড়াকে গলাকেটে হত্যার পর মাটিচাপা, আটক ১
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৩৩নং ওয়ার্ডের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বড়ইকান্দী গ্রামে স্থাপিত এই মসজিদটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ও দক্ষিণ চর কালিবাড়ি আশ্রয়ণ জামে মসজিদ’।
সরেজমিনে এই প্রতিবেদক দেখতে পান, নবনির্মিত এক কক্ষবিশিষ্ট মেঝে পাকা মসজিদটির দেয়াল ও চাল টিনের। সামনে ছোট্ট বারান্দা। পাশেই বসানো হয়েছে সাবমারসিবল পাম্প। পাশে ওজুখানা ও বাথরুম। উঁচুতে টানানো হয়েছে ৩টি মাইক। দুপুর ১টা বাজতেই মসজিদের মাইকে ভাসছে জোহরের আযান। হিজরাদের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদে প্রবেশ করছে স্থানীয় কয়েকজন বয়স্ক ও তরুণ মুসল্লি। তারা সবাই এক সঙ্গে জামায়াতের সঙ্গে জোহরের নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে কথা হয় স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে। কথা হয় সেতু বন্ধন হিজড়া কল্যাণ সংঘের কয়েক সদস্যের সঙ্গে।
আখি হিজরা নামে একজন বলেন, ‘সারা জীবন শুনে আসছি, হিজরা কেউ মারা গেলে তাদের নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। না হয় নদীর তীরে কোথাও কবর দেওয়া হয়। কোনো গোরস্থান ছিল না। এখন আমাদের মসজিদের পাশাপাশি কবরস্থানেরও ব্যবস্থা হয়েছে।’
সেতু বন্ধন হিজড়া কল্যাণ সংঘের সভাপতি জয়িতা তনু হিজড়া বলেন, ‘বড়ইকান্দী গ্রামে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে আমরা ৪০ জন হিজড়া বসবাস করি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশে এলাকার মসজিদে আমাদের কয়েকজন নামাজ পড়তে গেলে অনেকেই হাসাহাসি ও কটূক্তি করে। পরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একটি মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেই। কিন্তু প্রয়োজন জায়গা ও অর্থের। তার কোনোটাই নেই আমাদের।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ জন্য আমরা বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়ার সঙ্গে দেখা করি। তার পরামর্শে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে ৩৩ শতক জমি বরাদ্দ পাই। সেই সঙ্গে বিভাগীয় কমিশনার আমাদের মসজিদের জন্য ২ লাখ টাকা অনুদানের ব্যবস্থা করে দেন। এটা দিয়েই আমরা এ মসজিদের প্রাথমিক কাজ করেছি।’
আরও পড়ুন: জীবনধারণে লড়ছেন জয়িতা পুরস্কার জয়ী খুলনার পাখি দত্ত হিজড়া
জয়িতা তনু বলেন, ‘এ মসজিদের জন্য কিছু মানুষের আর্থিক সহযোগিতায় এবং নিজেদের টাকায় হাফেজ মাওলানা কারিমুল ইসলাম নামের একজন ইমাম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি গত ২০ দিন ধরে এ মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজের ইমামতি করছেন। এতে হিজড়াসহ এলাকাবাসীও নামাজ পড়ছেন।’
তিনি আরও বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে নির্মিত এই মসজিদটি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের প্রথম। পাশাপাশি একটি মাদরাসা, ৩ তলা মসজিদ কমপ্লেক্সসহ কবরস্থান ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুত এসব প্রতিষ্ঠান বাস্তবে রূপ নেবে।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘আমরা এলাকার মানুষ এই হিজরাদের কাজ-কর্মে সবদিক দিয়ে সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে আসছি। তারা আমাকে এই মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করেছেন। আমরা মিলে-মিশে এই মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, জুম্মার নামাজ আদায় করি। তারাবির নামাজ আদায় করা হয়। এখন থেকে কেউ আর হিজড়াদের এ মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে কটূক্তি করতে পারবে না।’
ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া বলেন, ‘স্থানীয় হিজড়া জনগোষ্ঠীর কয়েকজন সদস্য আমার কাছে এসে মসজিদ ও কবরস্থানের জন্য জমি চাইলে তাদের ৩৩ শতক জমি সরকার থেকে বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করি। এরপর সম্প্রতি তারা মসজিদের ঘর নির্মাণের জন্য আমার কাছে সহযোগিতা চান। পরে আমি তাদের জন্য একজন বিত্তবান মানুষের কাছ থেকে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তারা এখন মসজিদ নির্মাণ করে নামাজ পড়ছেন। এটা ভালো উদ্যোগ।’
আরও পড়ুন: ‘হিজড়া’ বলে কটুক্তির প্রতিবাদ করায় শিশু শুভকে হত্যা, গ্রেপ্তার ৩