বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন অংশীদারিত্বকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং আরও শক্তিশালী, সবুজ ও স্বাস্থ্যকর বৈশ্বিক উন্নয়নের প্রচারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ এজেন্ডার ১৭টি লক্ষ্যের সময়োপযোগী অর্জনে সহায়তা করতে কাজ করছে।
ঢাকায় আসার পর প্রথম সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূত ইউএনবিকে বলেন, ‘আমরা আশা করি, বাংলাদেশ চীনের সহায়তা, অগ্রাধিকারমূলক ঋণ এবং বৈশ্বিক উন্নয়ন ও দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা তহবিলকে সক্রিয়ভাবে নীতিগত সংলাপ, অভিজ্ঞতা বিনিময়, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ব্যবহারিক সহযোগিতা পরিচালনার জন্য ব্যবহার করবে।’
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০২১ সালে জাতিসংঘে জিডিআই উত্থাপন করেন।
রাষ্ট্রদূত বলেন, গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, মহামারি মোকাবিলা ও ভ্যাকসিন, উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও সবুজ উন্নয়ন, শিল্পায়ন, ডিজিটাল অর্থনীতি এবং ডিজিটাল যুগে সংযোগসহ ৮টি অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে প্রচার করে।
আরও পড়ুন: ঢাকায় চীনা বিশেষ দূত, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ভিশন-২০৪১ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগুলোই গুরুত্বপূর্ণ।’
জাতিসংঘ অনুসারে, ১০০টিরও বেশি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা জিডিআইয়ের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছে এবং ৬৮টি দেশ জাতিসংঘে জিডিআইয়ের গ্রুপ অব ফ্রেন্ডসে যোগ দিয়েছে।
জুলাই মাসে গ্লোবাল অ্যাকশন ফোরাম ফর শেয়ার্ড ডেভেলপমেন্টের প্রথম উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ১৫৮টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ৮০০ জনেরও বেশি অতিথি অনলাইন ও সশরীরে অংশ নেন। বাংলাদেশের পক্ষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
আরও পড়ুন: ঢাকা-বেইজিং বন্ধুত্বে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ‘আশার সেতু’: চীনা রাষ্ট্রদূত
ভবিষ্যতের অগ্রাধিকার
বাংলাদেশ ও চীন ২০২৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করবে।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘অতীতের অর্জনগুলো পর্যালোচনা করতে এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে এটি উপযুক্ত উপলক্ষ।’
তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, চীন ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিজেদের জাতীয় স্বপ্ন বাস্তবায়নে যৌথ উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।
চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘ব্যবহারিক সহযোগিতা চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের মূল ভিত্তি। ২০১৬ ও ২০১৯ সালে উচ্চ পর্যায়ের সফরকালে সম্মত হওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সময় আমরা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এবং গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের আওতায় কানেক্টিভিটি অবকাঠামো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, নীল অর্থনীতি, ডিজিটাল ক্ষমতায়ন প্রভৃতি বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আরও কিছু করার উদ্যোগ নেব।’
বাণিজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্থানীয় রপ্তানিকারকদের বাংলাদেশি পণ্যের জন্য চীনের ৯৮ শতাংশ শূন্য শুল্ক সুবিধা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করা হয়। এ ছাড়া চীনে অনুষ্ঠিত চায়না ইন্টারন্যাশনাল ইমপোর্ট এক্সপো, চায়না-সাউথ এশিয়া এক্সপো ও ক্যান্টন ফেয়ারের মতো প্রদর্শনীতে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' ব্র্যান্ডটি প্রদর্শন করতে উৎসাহিত করা হয়।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চলকে স্মার্ট বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশলের পাশাপাশি চীনের উচ্চমানের উন্নয়ন দৃষ্টান্ত পরিবেশন করতে উচ্চমানের ও উচ্চমূল্যের শিল্পের দিকে নজর দেওয়া উচিৎ।
রাষ্ট্রদূত ইয়াও বলেন, ‘আমরা চীনা উদ্যোক্তাদের নতুন জ্বালানি, আইসিটি, উন্নত উৎপাদন এবং কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহিত করব। ঢাকায় দায়িত্ব পালনকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ, সামরিক বিনিময়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বয় এবং সামুদ্রিক সহযোগিতা আরও জোরদার করব।’
তিনি বলেন, ‘অবশ্যই চীনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুতদের দ্রুত ও টেকসই প্রত্যাবাসনের সুবিধার্থে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতায় আমি আমার ভূমিকা পালন করব।’
আরও পড়ুন: নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়: চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও
সবুজ জ্বালানি উৎপাদন
এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, প্যারিস চুক্তির প্রধান ভূমিকা পালনকারী চীন ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন শীর্ষে এবং ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতায় পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘২০৩৫ সালের মধ্যে চীন বিস্তৃতভাবে পরিবেশবান্ধব কাজ ও জীবনের উপায় স্থাপন করবে, শীর্ষে পৌঁছানোর পরে কার্বন নির্গমন হ্রাস করবে, পরিবেশের উন্নতি করবে এবং মূলত একটি 'সুন্দর চীন' বিকাশের লক্ষ্য অনেকাংশে অর্জন করবে।’
বাংলাদেশও পরিবেশগত অবনতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
২০২০ সালে গৃহীত মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা (এমসিপিপি) ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের উন্নয়নের দৃষ্টান্তকে সবুজ রূপান্তরের পথে পরিচালিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে উল্লেখ করে চীনা রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘ভাগ্যক্রমে, দেশটি বিষয়গুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে ভালোভাবে সচেতন হয়েছে এবং প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে।’
রাষ্ট্রদূত ইয়াও বলেন, ‘বাংলাদেশ ও চীন যখন পরিবেশগত লক্ষ্য অর্জনে একত্রিত হচ্ছে, তখন দুই দেশের জন্য সবুজ উন্নয়ন কৌশলে সমন্বয় সাধনের উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়ে গেছে, যার ফলে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি অভিন্ন মানব সম্প্রদায় গড়ে তোলা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে, আমরা ইতোমধ্যে এই বিষয়ে সহযোগিতা শুরু করেছি। কয়েক মাস আগে যখন কক্সবাজারে গিয়েছিলাম তখন দেখলাম, অনেক বাসার ছাদে চাইনিজ ব্র্যান্ডের ফটোভোলটাইক প্যানেল।’
আরও পড়ুন: ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে এজেন্ডাগুলোর অগ্রগতির আশা করছে রাশিয়া ও চীন
সবুজ যানের পরবর্তী প্রজন্ম
গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, চলতি মাসের শুরুতে ঢাকায় বাংলাদেশের প্রথম বৈদ্যুতিক যানবাহন (ইভি) চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হয়।
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি পত্রিকায় পড়েছি। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে নিবন্ধিত রয়েছে মাত্র ৩৫টি ইভি। এটি বাংলাদেশের ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যার তুলনায় বেশ নগণ্য।’
চীন হচ্ছে ইভির প্রধান নকশাকার ও প্রস্তুতকারক। চীনের রাস্তায় ১৬ মিলিয়নেরও বেশি ইভি এবং মিশ্র-জ্বালানির যানবাহন চলছে এবং সংখ্যাটি এখনও বাড়ছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা আরও চীনা ইভি নির্মাতাদের বাংলাদেশে আসতে, স্থানীয় বাজার অন্বেষণ করতে এবং বাংলাদেশের জনগণের চাহিদা মেটাতে উৎসাহিত করব। যা বাংলাদেশ পরবর্তী প্রজন্মের সবুজ যানের দিকে যেতে সহায়তা করবে।’
আরও পড়ুন: ব্রিকসে যোগদানে বাংলাদেশকে সমর্থন করবে চীন: প্রেসিডেন্ট শি