প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। এই দুটি পরীক্ষার ফলাফলের সাথে সাথে নির্ধারিত হয় তাদের ভবিষ্যত শিক্ষাজীবন। স্বভাবতই এগুলোর সার্টিফিকেট প্রাপ্তিটা শত কষ্টের ফসল হিসেবে দারুণ এক অর্জন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ নথির তথ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ভুল সাধিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে জীবনের নানা ক্ষেত্রে বয়ে বেড়াতে হয় এই ভুলগুলো। তাই সময় থাকতে আগে ভাগেই তথ্যগুলো সংশোধন করা জরুরি। যথাসম্ভব সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার পরপরই এই বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া উচিত। আসুন জেনে নেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেটে তথ্য সংশোধনের নিয়মগুলো।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেটের তথ্য সংশোধন করার পদ্ধতি
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
দরকারি নথিগুলোর মধ্যে প্রথমে এফিডেভিট লাগবে এবং তা অবশ্যই ২০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে হতে হবে। তারপর লাগবে যে কোন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় দেয়া বিজ্ঞাপনের কপি। শিক্ষার্থীর নাম সংশোধনের জন্য দরকার হবে অনলাইনে করা জন্ম নিবন্ধনের ইংলিশ ভার্সন এর কপি।
সার্টিফিকেটে পিতা-মাতার নাম সংশোধন করতে হলে তাদের জাতীয় পরিচয় পত্র/ভোটার আইডি কার্ড (এনআইডি)-এর কপি। অনলাইনে আবেদনের ক্ষেত্রে এই প্রতিটি কাগজের সফ্ট কপি পিডিএফ ফরমেটে আপলোড করে সাবমিট করতে হবে।
পড়ুন: অনলাইনে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করার নিয়ম
এফিডেভিট করার প্রক্রিয়া
সরকারি অধিভুক্ত নোটারি পাবলিক বা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট-এর কাছ থেকে এই এফিডেভিট করতে হবে। আবেদনকারি ১৮ বছরের কম বয়সী হলে অথবা পিতা-মাতা নামের ভুল বানান সংশোধন করতে হলে পিতা-মাতা এফিডেভিট করবেন।
জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া
দেশের যে কোন দৈনিক পত্রিকার অফিসে গিয়ে বিজ্ঞাপনের জন্য শিক্ষার্থীর বর্তমান সার্টিফিকেটের তথ্যাবলি জমা দিতে হবে। এ সময় শিক্ষার্থী যে অংশগুলো সংশোধন করতে চান সেগুলো স্পষ্ট করে উল্লেখ করে দিবেন। অবশেষে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হলে পত্রিকা থেকে তা কেটে আবেদনের জন্য আলাদা করে রাখতে হবে।
তথ্য সংশোধনের জন্য অনলাইনে আবেদন পদ্ধতি
শিক্ষার্থীদেরকে স্ব স্ব শিক্ষাবোর্ডের ওয়েবসাইট থেকে আবেদন করতে হবে। তবে দিনাজপুর ও বরিশাল বোর্ড এখনো অনলাইন প্রক্রিয়ার আওতায় আসেনি। প্রতিটি বোর্ডের অনলাইন তথ্য সংশোধনের আবেদন একই তাই নমুনা হিসেবে এখানে ঢাকা বোর্ডের আবেদন প্রক্রিয়া দেখানো হলো।
পড়ুন: দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামে সময় কাজে লাগানোর উপায়
প্রথমেই যেতে হবে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইট-এ এবং ক্লিক করতে হবে নাম ও বয়স সংশোধনের আবেদন অপশনটিতে। নতুন পেজে যে পরীক্ষার সার্টিফিকেটের তথ্য সংশোধনের আবেদন করা হচ্ছে তার অর্থাৎ জেএসসি, এসএসসি, বা এইচএসসি-এর রোল, রেজিস্ট্রেশন, পরীক্ষার বছর সাবমিট করতে হবে। এতে করে সার্টিফিকেট সংশোধনের জন্য একটি আবেদন ফরম পাওয়া যাবে।
আবেদন ফরম ভালোভাবে পূরণ করে এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আপলোড করে সাবমিট করবেন। এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে, শিক্ষার্থী একসাথে সর্বোচ্চ দুটি পরীক্ষার সার্টিফিকেটের নাম সংশোধনের জন্য আবেদন করতে পারবে। পরীক্ষার পাশের বক্সে ক্লিক করা মাত্রই কাঙ্ক্ষিত তথ্যগুলো দেখানো হবে।
এবার নিজের নাম, পিতা-মাতার নাম ও জন্ম তারিখের মধ্যে যে তথ্যটি সংশোধন করা দরকার তার উপর ক্লিক করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে একাধিক তথ্য সংশোধনের জন্য একাধিক আবেদন করতে হবে।
পড়ুন: এয়ার কন্ডিশনার ছাড়াই গরমে ঘর ঠান্ডা রাখার কার্যকরী উপায়
আবেদনের সময় মোবাইল নাম্বার দিতে হবে যেখানে পরবর্তীতে তথ্য সংশোধনী বিষয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বার্তা পাঠানো হবে। অতঃপর প্রয়োজনীয় নথি আপলোড করে সাবমিট করলে অনলাইন আবেদন সম্পন্ন হবে।
সাবমিটের সাথে সাথেই ইতোমধ্যে প্রদানকৃত মোবাইল নাম্বারে একটি আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়া হবে। এর মানে হলো ওয়েবসাইটের অধীনে শিক্ষার্থীর একটি প্রোফাইল তৈরি হয়েছে। প্রোফাইল থেকে প্রেরণকৃত আবেদনটি ডাউনলোড করে তার একটা প্রিন্ট কপি রাখা যাবে।
পূর্বের মত নাম ও বয়স সংশোধন অপশন-এ প্রবেশ করে ‘সর্বশেষ অবস্থা’ নামের অপশনে ক্লিক করলে আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা দেখা যাবে। আবেদন ফি জমা না হলে তা জমা দেওয়ার নির্দেশনা থাকবে। অন্যথায় শিক্ষার্থীর নিজের স্কুল বা কলেজ থেকে আবেদন পত্র ফরওয়ার্ড করতে বলা হবে।
পড়ুন: অনলাইনে গ্যাস বিল পরিশোধ করার নিয়ম
আবেদন ফি জমা দেয়ার নিয়ম
অনলাইনে আবেদনের সময়ে সোনালী স্লিপ নামে একটি অপশন পাওয়া যাবে যেখানে ক্লিক ফি জমা দেয়ার তিনটি ক্যাটাগরি দেখানো হবে। সেগুলো হলো- ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং এবং কার্ড।
কার্ড বা মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে ফি পরিশোধ করলে সাথে সাথেই ফি প্রাপ্তির রশিদ দেওয়া হবে। এটি ডাউনলোড দিয়ে প্রিন্ট করে রাখতে হবে।
ব্যাংক ক্যাটাগরি বাছাই করলে সোনালী স্লিপ ডাউনলোড করতে হবে। এটি ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার সময় জমা রশিদ হিসেবে কাজ করবে। এর গ্রাহক অংশটি ব্যাংকের নিকট থেকে বুঝে নিয়ে তা পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য নিজের কাছে রেখে দিতে হবে।
পড়ুন: রাতে হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় প্রয়োজনীয় কিছু সতর্কতা
স্কুল অথবা কলেজ থেকে আবেদন ফরওয়ার্ড প্রক্রিয়া
যাবতীয় কাগজপত্র সহ আবেদনপত্রটি নিয়ে শিক্ষার্থী নিজ স্কুল বা কলেজে জমা করবেন। অতঃপর পুরো আবেদন যাচাই করে প্রতিষ্ঠান তা ফরোয়ার্ড করে দিবে। আর এর সাথে সাথে আইডি-পাসওয়ার্ড দিয়ে শিক্ষাবোর্ডের ওয়েবসাইটে লগইন করে করলে প্রক্রিয়াধীন আবেদনের স্ট্যাটাস দেখা যাবে। এর পরবর্তী করণীয় মেসেজ করে জানানো হবে। কমপক্ষে ১৫ দিন আর কোন কারণে দেরী হলে সর্বোচ্চ ৬ মাস পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
বড় কোন সংশোধনীর জন্য বোর্ড মিটিং
সার্টিফিকেটের তথ্য সংশোধনী মুলত বোর্ড মিটিং-এর মাধ্যমে সংশোধন করা হয়ে থাকে। নামের মাঝে খালি জায়গা না থাকলে, আক্ষরিক ভুলের মত ছোটখাট ভুলের জন্য বোর্ড মিটিংয়ে ডাকা হয় না। পুরো নাম বা টাইটেল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে বোর্ড মিটিংয়ে ডাকা হতে পারে। আর তা অবশ্যই ম্যাসেজ করে জানিয়ে দেয়া হবে। এ সময় যাবতীয় কাগজপত্রের মুল কপি সঙ্গে নিয়ে ম্যাসেজে উল্লেখিত সময়ে ঢাকা বোর্ডে হাজির হতে হবে। বোর্ড মিটিং কর্তৃক তথ্য সংশোধন হলে তা ম্যাসেজের মাধ্যমে জানানো হবে।
পড়ুন: বয়স্ক ভাতার জন্য আবেদন করার নিয়ম
সংশোধনকৃত সার্টিফিকেট উত্তোলনের আবেদন
এবার সংশোধনকৃত সার্টিফিকেট উঠানোর পালা। এবার আগের মত একইভাবে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের ওয়েবসাইটের অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন-এ যেতে হবে। এবার ক্লিক করতে হবে ডকুমেন্ট উত্তোলনের আবেদন অপশনে। এবার পরীক্ষা, আইডি, রেজিস্ট্রেশন নাম্বার দিয়ে ফাইন্ড অপশন এ ক্লিক করলে সার্টিফিকেটের সেই আবেদন ফর্মটি দেখাবে। সবশেষে প্রয়োজনীয় তথ্য ও সংযুক্তি দিয়ে সাবমিট বাটনে ক্লিক করলে আবেদন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে।
চূড়ান্ত সার্টিফিকেট এক সপ্তার মধ্যেই হাতে পাওয়া যায়। এই সার্টিফিকেট উত্তোলনের জন্য পূর্বে আবেদন ফি-এর মত উত্তোলন ফি জমা দিতে হয়। ডকুমেন্ট উত্তোলন বিষয়ক ম্যাসেজ আসা শুরু হয় ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যেই। ম্যাসেজে জানানো সময়ে বোর্ড-এ গিয়ে আবেদনের কপি, আবেদন ফি প্রাপ্তি রশিদ, প্রিন্ট অর্ডার এবং পুরাতন ডকুমেন্ট দিয়ে নতুন সার্টিফিকেটটি সংগ্রহ করতে হয়।
একাধিক সার্টিফিকেট বা সার্টিফিকেটের পাশাপাশি মার্কশীট, প্রবেশ পত্র ও রেজিষ্ট্রেশন কার্ড তুলতে গেলে প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা ভাবে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দিয়ে আবেদন করতে হয়। আর সব ডকুমেন্ট হাতে পেতে প্রায় দেড় মাসের মত অপেক্ষা করতে হয়।
পড়ুন: এটিএম বুথে কার্ড আটকে গেলে কি করবেন ? এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
আবেদন ও সংশোধিত সার্টিফিকেট উত্তোলন খরচ
প্রতিটি পরীক্ষার সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন ফি ৫০০ টাকা। এর সাথে অনলাইন আবেদন ফি বাবদ ৭.৮৮ টাকা চার্জ কাটা হয়। সব মিলে একটি পরীক্ষার জন্য আবেদন খরচ ৫০৭.৮৮ টাকা। তবে ব্যাংকে জমা দিলে ব্যাংক-চার্জ ৫৮ টাকা সহ মোট খরচ হয় ৫৫৮ টাকা।
সংশোধিত নতুন সার্টিফিকেট উত্তোলন ফি ৫০০ টাকা। সাথে অনলাইন চার্জ ৭.৮৮ টাকা। আর ব্যাংকের ক্ষেত্রে ব্যাংক চার্জ আগের মতই ৫৮ টাকা। পরীক্ষার অন্যান্য সব ডকুমেন্টের জন্যও একই চার্জ, তবে রেজিস্ট্রেশন কার্ড এর জন্য ২০০ টাকা দিতে হয়। এর সাথে অনলাইন চার্জ কমে দাড়ায় ৪.১৫ টাকায় কিন্তু ব্যাংক চার্জে কোন পরিবর্তন নেই।
শেষাংশ
উপরোক্ত করণীয়গুলো মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সার্টিফিকেটের তথ্য সংশোধনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এগুলোর সর্বাধিক গুরুত্বের কারণে এ ধরনের ভুল যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। এজন্য পরীক্ষার রেজিষ্ট্রেশনের সময়েই শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত প্রতিটি তথ্য সতর্কতার সাথে লিপিবদ্ধ করতে হবে। বিশেষ করে বাংলা ও ইংরেজিতে নিজের নাম সহ বাবা-মার নামের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরবর্তীতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন নথি প্রস্তুতকরণে মুলত এই তথ্যগুলোরই একদম অপরিবর্তিত সংস্করণ প্রয়োজন হয়।
পড়ুন: শিশুদের ই-পাসপোর্টের নিয়ম: কীভাবে আপনার অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের পাসপোর্ট করবেন