রাজধানীর মহাখালীতে পর্যটন করপোরেশনের ন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ফুড অ্যান্ড বেভারেজ প্রোডাকশন (রন্ধন প্রশিক্ষণ) বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন জাহিদা বেগম।
২১ বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়ে শেফ তৈরি করছেন তিনি। তার হাত ধরে অসংখ্য নারী আজ দেশে-বিদেশে উদ্যোক্তা, শেফ, হোম ডেলিভারি ক্যাটারার হিসেবে কাজ করছেন। কেউ কেউ নিজেরা কুকিং স্কুল দিয়েছেন আবার অনেকে নিয়মিত টেলিভিশন, ইউটিউব, ফেসবুক ইত্যাদিতে কুকিং শো করছেন।
আজ শুক্রবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ইউএনবিকে নিজের গল্প বলেছেন শেফগুরু হিসেবে পরিচিত জাহিদা বেগম।
২০০০ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনে কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন জাহিদা। ২০০৩ সাল থেকে তিনি করপোরেশনের ন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ফুড অ্যান্ড বেভারেজ প্রোডাকশনের (রন্ধনশিল্পবিষয়ক প্রশিক্ষণ) প্রশিক্ষক হিসেবে পদায়িত হন এবং পরবর্তীতে বিভাগীয় প্রধান হন।
যদিও তার ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৯৫ সালে লিমো ইলেকট্রনিকসে, বিপণন নির্বাহী হিসেবে এবং ১৯৯৮ সালে ঢাকার শেরাটন হোটেলে (বর্তমানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা ছিলেন।
জাহিদা বেগমের প্রশিক্ষকের ক্যারিয়ার শুরুর দিকে তিনি দেখেছেন শেফ এর কাজ শিখতে নারীরা খুব কম আসেন। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি দেখলেন- মূলত পরিবার থেকে তাদের অনুৎসাহিত করা হয়। অথচ সমগ্র পৃথিবী জুড়েই রন্ধনশালার সেরা অর্জনে কিন্তু নারীরাই।
আরও পড়ুন: কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে নয়: জবি ভিসি
তিনি বলেন, বাংলাদেশে শিল্পভিত্তিক রন্ধনে এই বিপরীত চিত্রের কারণ হলো নারীদের পরিবার ও অভিভাবকদের মধ্যে হোটেল-রেস্টুরেন্ট শিল্পে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে ভুল ধারণা।
জাহিদা বেগম ভর্তিচ্ছু নারীদের অভিভাবক, স্বামী ও পরিবারগুলোকে কাউন্সেলিং করা শুরু করলেন। তার প্রচেষ্টায় আস্তে আস্তে নারীরা শেফ হওয়ার জন্য উৎসাহিত হয়ে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। তার হাত ধরে অসংখ্য নারী আজ দেশে-বিদেশে উদ্যোক্তা, শেফ, হোম ডেলিভারি ক্যাটারার হিসেবে কাজ করছেন। কেউ কেউ নিজেরা কুকিং স্কুল দিয়েছেন আবার অনেকে নিয়মিত টেলিভিশন, ইউটিউব, ফেসবুক ইত্যাদিতে কুকিং শো করছেন।
তিনি তার কর্মস্থলের বাইরে বহু প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক হিসেব কাজ করার পাশাপাশি নিরাপদ খাবার, হাইজিন (খাবার প্রস্তুত ও পরিবেশন প্রক্রিয়া এবং কর্মীদের স্বাস্থ্যসম্মত নীতির চর্চা), পুষ্টি, পর্যটন ও কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল কিচেন সেট–আপ ইত্যাদি বহুবিষয়ে বিষয়ে কাজ করছেন।
পর্যটন মেলায় অংশ নিতে, রন্ধন প্রশিক্ষণ নিতে, দিতে বা রন্ধন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তিনি বহুবার ভ্রমণ করেছেন ভারত। এছাড়াও গেছেন জাপান, সাইপ্রাস ও নেপালে। শিখছেন জাপানি ও চীনা ভাষা। এ ছাড়াও রন্ধনশিল্পবিষয়ক নানা প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত থাকার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের রন্ধনবিষয়ক প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন ও বিভিন্ন রেসিপি উপস্থাপন করে থাকেন।
আরও পড়ুন: রাইড-শেয়ারিংয়ে বাড়ছে ঢাকার কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ
ইউটিউব চ্যানেল ডক্টর টিভিতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিয়ে ৫০ পর্বের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন তিনি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে দুই বার নিয়োগ পেয়েছেন।
জাহিদা তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেশে–বিদেশে বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ভারতে অনুষ্ঠিত ইয়াং শেফ অলিম্পিয়াডে ওয়াইসিও স্পিরিট এবং নাইফ স্কিল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন জাহিদা।
এর আগে ইয়াং শেফ অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে অ্যাম্বাসেডর অ্যাওয়ার্ড, ইন্টারন্যাশনাল স্কিল অ্যাওয়ার্ড, বেস্ট মেন্টর অ্যাওয়ার্ড, ওয়েলকাম স্কিল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ২০২৪ সালেও উক্ত প্রতিযোগিতায় তিনি দু’টি পুরস্কার পেয়েছেন।
২০২২ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বেঙ্গল বিজনেস সামিটে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রচারণা ও ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য বিশেষ পুরস্কার পেয়েছেন জাহিদা। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড, সরকারের জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের বেস্ট পারফরমার অব দ্য ইয়ার (২০১৫) পেয়েছেন তিনি।
সার্বিক বিষয়ে জাহিদা বেগম বলেন, দীর্ঘ সময় সরকারের প্রধান নারী হওয়ায় এবং সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকায় দেশের নারীদের অগ্রগতি ও প্রগতি উল্লেখযোগ্য। তবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হতে নারীরা এখনও অনেক দূরে অবস্থান করছে। সন্তান ধারণ ও প্রতিপালন ছাড়াও সামাজিক বাধার কারণে নারীরা পর্যটন সেক্টরে ক্যারিয়ার গঠনে দ্বিধান্বিত।
তিনি আরও বলেন, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও কালিনারি সেক্টরে নারীদের ক্যারিয়ার গঠনে তাদের অভিভাবক ও স্বামীদের সহযোগিতা সর্বাধিক প্রয়োজন। তবে সম্প্রতি দেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পর্যটন পাঠ্য বিষয় হিসেবে চালু হয়েছে এবং তাতে প্রচুর নারী শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে।
নারীরা যদি নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও প্রসারিত করতে পারে এবং পরিবারের সহযোগিতা পায় তবে রন্ধনশিল্পী বা শেফ হিসেবে ঈর্ষণীয় সাফল্য পাবে বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন।
আরও পড়ুন: দুর্যোগের সময়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপদ বোধ করেন না প্রায় ৬৭ শতাংশ নারী