দীর্ঘদিন ধরেই বাঘ আতঙ্কে রয়েছে সুরন্দরবন সংলগ্ন গ্রামবাসী। সুন্দরবন ছেড়ে বিশেষ করে রাতে মাঝে মধ্যেই লোকালয়ে ঢুকে একের পর এক গ্রাম ঘুরে বেড়াচ্ছে। হামলা চালাচ্ছে গ্রামবাসী ও গবাদী পশুর ওপর। গ্রামবাসীর পাল্টা হামলায় বাঘও প্রাণ হারাচ্ছে।
সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামে বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব অনেক দিনের। এ অবস্থায় বাগেরহাটের একদল ক্ষুদে বিজ্ঞানী বাঘসহ যে কোন বন্যপ্রাণী সনাক্তকরণের জন্য এক ধরনের আলোক রশ্মি উদ্ভাবন করেছে। রাতে বাঘ বাড়িতে ঢুকলে ইনফ্রারেড আলোর রশ্মির মাধ্যমে শনাক্ত করা যাবে এবং এক ধরনের শব্দ বেজে উঠবে। আবার রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে উচ্চক্ষমতা সম্পূর্ণ আলো এবং শব্দ সৃষ্টি করে ওই বাঘকে লোকালয় থেকে ফিরিয়ে দেয়া যাবে।
বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার কালিদাস বড়াল স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের পাঁচ ক্ষুদে বিজ্ঞানী এই উদ্ভাবন করেছে। বাগেরহাট জেলা পরিষদ অডিটোরিয়াম চত্বরে দুই দিনব্যাপী ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় তারা এই উদ্ভাবনী প্রদর্শন করেছে। এমন উদ্ভাবনী দেখতে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নানা বয়সের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের ভিড় লেগে ছিল।
আরও পড়ুন: নাসার স্পেসএক্স মিশনের নভোচারীরা পৃথিবীতে ফিরছেন
ক্ষুদে ওই বিজ্ঞানীরা বলছে, বাঘ রক্ষা এবং একইসঙ্গে গ্রামবাসীকে বন্যপ্রাণী থেকে রক্ষা করতে তাদের এই উদ্ভাবন। এই আলোক রশ্মি বন্যপ্রাণী বা পরিবেশের কোন ধরনের ক্ষতি করবে না বলেও তারা জানায়।
সুন্দরবন বিভাগ বলছে, ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের বাঘ শনাক্তকরণের এই উদ্ভাবন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চাওয়া হবে। বিশেষজ্ঞরা মতামত দিলে বাস্তবায়নের বিষয় পরামর্শ দেয়া যেতে পারে।
রাতে বাঘসহ বন্য প্রাণী সনাক্তকরণের উদ্ভাবক এই পাঁচ ক্ষুদে বিজ্ঞানী হচ্ছে- মো. ফারদ্বীন খান, প্রিতিরাজ বিশ্বাস, রজত মন্ডল, সুদিপ্ত মন্ডল ও ইব্রাহিম। এরা সবাই জেলার চিতলমারী উপজেলার কালিদাস বড়াল স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র।
ক্ষুদে বিজ্ঞানী মো. ফারদ্বীন খান জানায়, বিভিন্ন সময় বাঘ সুন্দরবন ছেড়ে বনসংলগ্ন লোকালয়ে প্রবেশ করছে। বাঘ গ্রামবাসীর ওপর হামলা করে। তেমনি গ্রামবাসীর হামলায় বাঘ নিহত হচ্ছে। গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে এমন সংবাদ দেখার পর বাঘ এবং গ্রামবাসীকে রক্ষার জন্য সে ভাবতে থাকে। এরপর তারা পাঁচ সহপাঠী মিলে নানা চেষ্টা করে বাঘসহ সব ধরনের বন্যপ্রাণী সনাক্তকরণের জন্য এই আলোক রশ্মি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। বন্যপ্রাণী থেকে নিরাপত্তার জন্য তারা সেমি স্মার্ট হাউজ তৈরি করে প্রদর্শন করেছে। তারা উদ্ভাবন করে দেখিয়ে দিয়েছে যে, রাতে বাঘ বা যে কোন ধরনে বণ্যপ্রাণী বাড়িতে প্রবেশ করলে ইনফ্রারেড আলোর রশ্মির মাধ্যমে শনাক্ত করা যাবে এবং একধরনের শব্দ বেজে উঠবে। আবার রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে উচ্চক্ষমতা সম্পূর্ণ আলো এবং শব্দ সৃষ্টি করে ওই বাঘকে লোকালয় থেকে ফিরিয়ে দেয়া যাবে।
মো. ফারদ্বীন খানের তথ্য মতে, এই উদ্ভাবনের জন্য তারা যা যা ব্যবহার করছে তার মধ্যে রয়েছে- একটি এলইডি আর সেন্সর, একটি ৯ ভোল্টের ব্যাটারি, ১০০ কে রেজিস্টার, একটি বার্জার (শব্দ তৈরির জন্য), লেজার লাইট, ব্যাটারি চার্জের বিদ্যুৎ অথবা সৌর বিদ্যুৎ এবং তিন ইঞ্চি ব্যাসার্ধের চারটি গোলীয় দর্পণ (কাঁচ)। এই সব উপাদান ব্যবহার করে লেজারের মাধ্যমে আলোক রশ্মি তৈরি করেছে তারা।
এই উদ্ভাবনী প্রদর্শন করতে তাদের সর্বমোট ব্যয় হয়েছে সাড়ে ৬শ’ টাকা। বনসংলগ্ন গ্রামে অল্প খরচে তাদের এই উদ্ভাবনী ব্যবহার করতে কয়েক হাজার টাকা ব্যয় হবে। বাঘ এবং মানুষ রক্ষা করতে ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা তাদের এই উদ্ভবনী সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে চায়।
সরকারি সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক সহায়তা এবং মানুষের প্রয়োজন হলে সুন্দরবন এলাকায় তাদের উদ্ভাবনী কার্যকারিতা তারা দেখাতে পারে বলে ফারদ্বীন জানায়।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, এ ধরনের উদ্ভাবনী ভাল উদ্যোগ। তবে এই আলোকরশ্মি বাঘের জন্য পরিবেশ বান্ধব কি না জানতে হবে। লেজারের আলোক রশ্মির কারণে বাঘ বা অন্য বন্যপ্রাণীর কোন ক্ষতি হতে পারে কিনা জানা দরকার। এই উদ্ভাবনী নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত চাওয়া যেতে পারে।
ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলার স্টল পরিদর্শন শেষে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান জানান, যে কোন ভাল উদ্ভাবন সমাজের উপকারে আসে। ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা রাতে বাঘসহ যে কোন ধরনের বন্যপ্রাণী সনাক্তকরণের জন্য যে উদ্ভাবন করেছে তা প্রশাংসার দাবি রাখে। এর সম্ভব্যতা যাচাই এবং মাঠ পর্যায়ে এর অর্থনৈতিক ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে।
কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, তাদের কাছে বাঘ সনাক্তকরণের জন্য শিক্ষার্থীদের ওই উদ্ভাবনী ভাল লেগেছে। যে কোন মানুষ তার বাড়িতে এই উদ্ভাবন ব্যবহার করতে পারে।
শনিবার বাগেরহাট জেলা পরিষদ অডিটোরিয়াম চত্বরে দুই দিনব্যাপী ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলার উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান। মেলায় জেলার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলে মোট ৫৫টি প্রতিষ্ঠান ৩৭টি স্টলে তাদের উদ্ভাবনী প্রদর্শন করে। রবিবার এই মেলা শেষ হয়েছে।
বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. হাফিজ আল-আসাদ জানান, ডিজিটাল উদ্ভাবনী এই মেলা মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। মেলায় ভূমি অফিসের স্টলে রবিবার ছয়জন ভূমির মালিক অনলাইনে তাদের জমির খাজনা বাবদ ২০ হাজার ১৩২ টাকা পরিশোধ করেছেন।
সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার পশ্চিম ধানসাগর গ্রামের আমিন চৌকিদার জানান, প্রায় প্রতিবছর দুই থেকে তিন বার সুন্দরবন ছেড়ে ভোলা নদ পাড়ি দিয়ে বাঘ তাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। গত বছর চারবার বাঘ তার বাড়ির ভিতরে চলে আসে। বাঘের ডাক শুনে তাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। বাঘের ভয়ে তাদের নির্ঘুম রাত কাটে। অনেক সময় বাঘ তাদের গরু-ছাগল খেয়ে ফেলে। মানুষের ওপর হামলাও করে। বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেতে গ্রামবাসী পাল্টা হামলা করে। অনেক সময় বাঘ গ্রামবাসীর হাতে প্রাণ হারায়। এ ধরনের উদ্ভাবন খুশির খবর বলে মনে করেন আমিন চৌকিদার।
জানা গেছে, সুন্দরবনের মোট আয়াতন ছয় হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থলভাগের পরিমাণ চার হাজার ১৪৩ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে সুন্দরবনের মোট আয়াতনের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা সংরক্ষিত বনাঞ্চল। আর গোটা সুন্দরবন জুড়েই রয়েল বেঙ্গল টাইগার কম বেশি বিচারণ করে থাকে। নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় মাঝে মাঝে মধ্যে বাঘ বনসংলগ্ন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। তৈরি হয় বাঘে মানুষে দ্বন্দ্ব। অনেক সময় গ্রামবাসীর হামলায় বাঘ প্রাণ হারাচ্ছে।
সর্বশেষ ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে জরিপে সুন্দরবনে বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি নির্ধারণ করা হয়। নতুন করে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করতে শিগগিরই সুন্দরবনে বাঘ গণনা শুরু হবে বলে বন বিভাগ জানায়।
বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০০১ সাল থেকে ২০২২ সালের এ পর্যন্ত সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে নানাভাবে ২৮টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দুস্কৃতিকারীদের হাতে ১৪টি, লোকালয়ে জনতার হাতে গণপিটুনিতে পাঁচটি,স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে আটটি এবং ঘুর্ণিঝড় সিডরে একটি বাঘ মারা গেছে। চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে ১৯টি।
আরও পড়ুন: মহাকাশযান গ্রহাণুর কক্ষপথ পরিবর্তন করতে সফল হয়েছে: নাসা
দুবাইয়ে চালকবিহীন বৈদ্যুতিক উড়ুক্কু গাড়ি চালাল চীনা প্রতিষ্ঠান