২০২৪ সালে নির্বাচন কমিশন টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে একটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে বলে ধরা হয়। একই বছরে গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা হয়।
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং মে ও জুন মাসে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন সেপ্টেম্বরে পদত্যাগের পর নভেম্বরে নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করে।
এছাড়া ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনি ক্ষেত্রে সংস্কার প্রবর্তনের জন্য দুটি কমিশন গঠন করা হয়। এর একটি ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এবং ড. তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।
৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করে। তবে এই নির্বাচন বিএনপিসহ কয়েকটি বড় রাজনৈতিক দল বর্জন করেছিল।
একতরফা নির্বাচনগুলো ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। নির্বাচনে কম ভোটার উপস্থিতি, অনিয়ম, শক্তিশালী বিরোধী প্রার্থীর অনুপস্থিতি, সত্যিকারের ভোটারদের পছন্দ করার সুযোগ না থাকা এবং সমঝোতার বা বদলি প্রার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল।
নির্বাচন কমিশন ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি ঘোষণা করলেও সরকারি পরিসংখ্যান ও মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণের মধ্যে অসঙ্গতি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে।
বিগত ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচনের মতো ২০২৪ সালের নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল। উল্লেখ্য, বিএনপিসহ সত্যিকারের বিরোধী দলগুলো ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন পুরোপুরি বর্জন করে।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন
গত মে থেকে জুন পর্যন্ত কয়েকটি ধাপে দেশের প্রায় ৪৬০টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সহিংসতা, অনিয়মের কারণে বিএনপি ও তার মিত্রদের বর্জনের ফলে সেই নির্বাচনও বিতর্কিত হয়।
সিটি করপোরেশন নির্বাচন
গত মার্চে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও কুমিল্লার মেয়র পদে উপনির্বাচন পরিচালনা করে ইসি।
সংস্কার কমিশন গঠন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এবং ড. তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করেছে।
এই কমিশনগুলো বর্তমানে দেশের নির্বাচনি এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য প্রতিবেদন প্রস্তুত করছে। প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংস্কার প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের পদত্যাগ
গত ৫ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে পাঁচ বছরের মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে এসে পদত্যাগ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ও চার নির্বাচন কমিশনার।
২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মেয়াদ শুরু করা কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনটি ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা, বিতর্কিত মন্তব্য এবং স্থানীয় নির্বাচনে অনিয়ম রোধে ব্যর্থতার জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল।
পদত্যাগ ঘোষণার সময় হাবিবুল আউয়াল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পর্যায়ক্রমে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেন।
দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) এবং নির্বাচনে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শও দেন তিনি।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও আউয়াল কমিশন তার আমলে ৯৯২টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৪৯৬টি উপজেলা পরিষদ, ৭১টি জেলা পরিষদ, ৯০টি পৌরসভা ও ১৬টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ও উপনির্বাচন পরিচালনা করে।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনার পদের জন্য যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের বাছাই করার জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
গত ২১ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ এম এম নাছির উদ্দিনকে নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং চারজনকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন। ২৪ নভেম্বর নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করে।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব আনোয়ারুল ইসলাম সরকার,সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমান মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তাহমিদা আহমেদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
দায়িত্ব গ্রহণের পর নাসির উদ্দিন প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেছেন যে, এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের পরেই জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব হবে।
কিন্তু নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগেই ইসি পুনর্গঠন নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।