ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের বহনকারী একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে। রবিবার ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় পার্বত্য এলাকায় হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। কুয়াশায় ঢাকা জঙ্গলে উদ্ধারকাজ শুরু করেছে বেশ কয়েকটি উদ্ধারকারী দল।
দেশটির প্রেসিডেন্ট ও তার সঙ্গে থাকা লোকজন ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। সোমবার সকালে একটি ড্রোন ফুটেজে দেখা গেছে, হেলিকপ্টারটি পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। এরপরই উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান।
রাইসি ও সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নেতৃত্বে ইরান গত মাসে ইসরায়েলে নজিরবিহীন ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
দুর্বল অর্থনীতি এবং নারী অধিকার নিয়ে শিয়া মতাদর্শের কারণে বছরের পর বছর ধরে গণবিক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছে ইরান। এরই মধ্যে তেহরান ও দেশের ভবিষ্যতের জন্য আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে বিষয়টি। কারণ ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধ বৃহত্তর মধ্য প্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে ভ্রমণ করছিলেন রাইসি। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী শহর জোলফার কাছে বিমানটি বিধস্ত হয়েছে। তবে পরে বলা হয়, এটি উজি গ্রামের কাছে আরও পূর্ব দিকে।
রাইসির সঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরআবদুল্লাহিয়ান, ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গভর্নরসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও দেহরক্ষীরা ছিলেন। একজন স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা ‘বিধস্ত (বিমান)’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তবে অন্যরা এটিকে ‘হার্ড ল্যান্ডিং’ বা ‘দুর্ঘটনা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
আইআরএনএ বা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের পক্ষ থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত রাইসির অবস্থা সম্পর্কে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।
সোমবার সকালে, তুর্কি কর্তৃপক্ষ একটি ড্রোন ফুটেজ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, জঙ্গলে আগুন দেখা গেছে। আর এটি ‘হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ বলে সন্দেহ করছে’। ফুটেজে দেখা গেছে, আজারবাইজান-ইরান সীমান্তের প্রায় ২০ কিলোমিটার (১২ মাইল) দক্ষিণে একটি খাড়া পাহাড়ের পাশে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত মন্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ ভাহিদি বলেন, 'প্রেসিডেন্ট ও তার সঙ্গীরা কয়েকটি হেলিকপ্টারে করে ফিরছিলেন কিন্তু খারাপ আবহাওয়া ও কুয়াশার কারণে একটি হেলিকপ্টার জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘উদ্ধারকারী কয়েকটি দল ওই এলাকায় যাচ্ছে, কিন্তু খারাপ আবহাওয়া ও কুয়াশার কারণে তাদের হেলিকপ্টারে পৌঁছাতে সময় লাগতে পারে।’
আইআরএনএ জানায়, এটি মূলত পার্বত্য বনাঞ্চল। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে একটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এসইউভি ছুটে যাওয়ার ছবি প্রচার করে বলা হয়েছে, ভারী বৃষ্টি ও বাতাসসহ খারাপ আবহাওয়ার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কুয়াশার মধ্যে হাঁটতেও দেখা গেছে উদ্ধারকারীদের।
জরুরি বিভাগের মুখপাত্র বাবাক ইয়েকতাপারাস্ত আইআরএনএ-কে বলেন, একটি উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার ওই এলাকায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রচণ্ড কুয়াশার কারণে সেটি অবতরণ করতে পারেনি।
সন্ধ্যায় তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে যে, তারা একটি চালকবিহীন আকাশযান পাঠিয়েছে এবং তল্লাশি ও উদ্ধার অভিযানে যোগ দিতে নাইট ভিশন সক্ষমতাসম্পন্ন একটি হেলিকপ্টার পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ইরান সরকারের মুখপাত্র আলী বাহাদোরি জাহরোমি বরেছেন, সূর্যাস্তের অনেক পরে তল্লাশি অভিযানে 'আমরা কঠিন ও জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি'।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রপতির হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার সর্বশেষ খবর জানা জনগণ ও গণমাধ্যমের অধিকার, তবে ঘটনাস্থলের আবহাওয়ার পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ায় এখন পর্যন্ত কোনো নতুন খবর পাওয়া যায়নি।’
খামেনি নিজেও জনগণকে দোয়া করার আহ্বান জানিয়েছেন।
খামেনি বলেন, 'আমরা আশা করি, সর্বশক্তিমান আল্লাহ প্রিয় প্রেসিডেন্ট ও তার সহকর্মীদের সুস্থ অবস্থায় জাতির কাছে ফিরিয়ে দেবেন।’
তবে সর্বোচ্চ নেতা জোর দিয়ে বলেন, যাই হোক না কেন ইরান সরকারের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। প্রেসিডেন্ট মারা গেলে ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, খামেনির সম্মতিক্রমে ভাইস ফার্স্ট প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেবেন। ৫০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজন করা হবে।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, রাইসির অনুপস্থিতিতে দেশটির ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার এরই মধ্যে দেশটির কর্মকর্তা ও বিদেশি সরকারের কাছ থেকে ফোন পেয়েছেন।
৬৩ বছর বয়সী কট্টরপন্থী রাইসি এর আগে দেশের বিচার বিভাগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাকে খামেনির একজন অনুসারী হিসেবে দেখা হয়। কিছু বিশ্লেষক মনে করতেন, খামেনির মৃত্যু বা অবসর গ্রহণের পরে ৮৫ বছর বয়সী এ নেতার স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন রাইসি।
রবিবার ভোরে আজারবাইজান সীমান্তে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের সঙ্গে একটি বাঁধ উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন রাইসি। আরাস নদীর উপর দুই দেশের নির্মিত তৃতীয় বাঁধ এটি। ২০২৩ সালে তেহরানে আজারবাইজান দূতাবাসে বন্দুক হামলা এবং ইসরায়েলের সঙ্গে আজারবাইজানের কূটনৈতিক সম্পর্কসহ দুই দেশের মধ্যে শীতল সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এই সফর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যাকে ইরানের শিয়া মতাদর্শের অনুসারীরা এই অঞ্চলে তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে।
ইরানের ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাইসি জয়ী হন, যে ভোটে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছিল। ১৯৮৮ সালে রক্তক্ষয়ী ইরান-ইরাক যুদ্ধ শেষে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দির মৃত্যুদণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে রাইসির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
রাইসির অধীনে ইরান এখন প্রায় উইপন-গ্রেড স্তরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শনের ক্ষেত্রে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে।
এদিকে দেশটিতে গণবিক্ষোভ চলছে বছরের পর বছর ধরে। ২০২২ সালে মাহসা আমিনি নামে এক নারীর মৃত্যু হয়। যাকে হিজাব না পরার অভিযোগে আটক করা হয়েছিল। বিক্ষোভের পর মাসব্যাপী নিরাপত্তা অভিযানে পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত এবং ২২ হাজারেরও বেশি লোককে আটক করা হয়।
গত মার্চে জাতিসংঘের একটি তদন্ত প্যানেল জানায়, আমিনির মৃত্যু ও 'শারীরিক নির্যাতনের' জন্য ইরান দায়ী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ইরান দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে তার সহযোগীরা ব্রিফ করেছেন। তবে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে যা প্রকাশিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি কিছু জানতে পারেননি।