গত কয়েক সপ্তাহে অনাহারে বহু ফিলিস্তিনির মৃত্যুর পর অবশেষে গাজা উপত্যকায় বাইরে থেকে খাদ্য সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে ইসরায়েল। এই খাদ্য সহায়তা পৌঁছানোর জন্য প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অভিযান বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তবে এই সীমিত যুদ্ধবিরতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ফিলিস্তিনিরা।
স্থানীয় সময় রবিবার (২৭ জুলাই) থেকে আকাশ ও স্থলপথে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ও পক্ষ থেকে গাজায় ত্রাণ ঢুকতে শুরু করে।
এর আগে এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, গাজায় মানবিক পরিস্থিতির অবনতি মোকাবিলায় নেওয়া পদক্ষেপের অংশ হিসেবে তিনটি এলাকার চলমান অভিযানে ‘কৌশলগত বিরতি’ ঘোষণা করা হবে। রবিবার থেকে পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন স্থানীয় সময় সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মুওয়াসি, দেইর আল-বালাহ ও গাজা শহরে সামরিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। তবে অন্যান্য এলাকায় অভিযান অব্যাহত থাকবে।
দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের কারণেই গাজার এই খাদ্যসংকট তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে জাতিসংঘ। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছে ইসরায়েল।
আরও পড়ুন: অনাহারে ১২৭ প্রাণহানির পর গাজায় ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি ইসরায়েলের
রবিবার রাতে বিমান থেকে ফেলার একটি ভিডিও প্রকাশ করে ইসরায়েল। এতে দেখা যায়, আটা, চিনি ও টিনজাত দ্রব্য ফেলা হচ্ছে। এছাড়া, জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও রবিবার দুপুরে ত্রাণবাহী বিমান থেকে সহায়তা ফেলেছে।
ইসরায়েল আরও জানিয়েছে, জাতিসংঘ যেন খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ করতে পারে সে জন্য মানবিক করিডর চালু করা হবে এবং একটি পানি পরিশোধন কেন্দ্র চালু করে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।
তবে গাজার বাসিন্দারা এই ত্রাণবিরতিকে সন্দেহের চোখে দেখেছেন। অনেকেই নানা ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
কারণ, রবিবার যুদ্ধবিরতির পরপরই গাজার একটি ভবনে ইসরায়েলি বিমান হামলায় এক নারী ও তার চার সন্তান নিহত হন। এছাড়াও, মধ্য গাজার আল-আকসা ও আল-আওদা হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা মানুষের ওপর ইসরায়েলি গুলিতে অন্তত ১৭ জন নিহত হয়েছেন।
গাজার গণিত শিক্ষক ও সাত সন্তানের বাবা ইয়াদ আল-বান্না বলেন, ‘মানবিক করিডর খোলা হলেও মজুদ সংকট এত গভীর, এটি এক বা দুই সপ্তাহ চললেও তেমন পরিবর্তন আসবে না। দুর্ভিক্ষ সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে।’
তিনি আরও জানান, রবিবার বাজারে আটা ছাড়া অন্য কোনো পণ্যের সরবরাহ বা দামে তেমন পরিবর্তন দেখা যায়নি; আটার দাম রাতারাতি প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে।
আল-নাসের হাসপাতালে কর্মরত এক চিকিৎসক জানান, অপুষ্ট শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো চিকিৎসা সহায়তা এখনো হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছেনি।
এছাড়া, আকাশপথে ত্রাণ সরবরাহ নিয়েও অনেকে সমালোচনা করেছেন। উত্তর গাজার এক শিক্ষাবিদ হিকমাত আল-মাসরি বলেন, ‘আকাশপথে ত্রাণ সরবরাহ পদ্ধতিটি ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য অপমানজনক। যুদ্ধের শুরুতে এই ব্যবস্থা বহু বেসামরিক নাগরিকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।’
আরও পড়ুন: ইরানে আদালতে সশস্ত্র হামলায় নিহত ৯, আহত ২২
রবিবারও আকাশ থেকে ফেলা ত্রাণের প্যাকেটের আঘাতে ১০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার জানান, রবিবার গাজায় কিছু ক্ষেত্রে চলাচলের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে ইসরায়েল। এক সপ্তাহের জন্য সহায়তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি।
তিনি বলেন, ‘এটা কিছুটা অগ্রগতি, তবে দুর্ভিক্ষ ও স্বাস্থ্য সংকট রোধে বিশাল পরিমাণ ত্রাণ প্রয়োজন।’
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত গাজায় অনাহারে অন্তত ১৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিশু। তবে গাজায় দুর্ভিক্ষ চলছে—এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইসরায়েল। তাদের অভিযোগ, জাতিসংঘ যথাযথভাবে সহায়তা বিতরণ করতে ব্যর্থ।
তবে জাতিসংঘ বলেছে, তারা গাজায় ত্রাণ পাঠানোর জন্য যে অনুরোধগুলো করেছে, তার বেশিরভাগই ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বাতিল করেছে। অক্সফামের অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড বিষয়ক প্রধান বুশরা খালিদি বলেন, ‘এখন যা প্রয়োজন, তা হলো গাজার সব সীমান্ত অবিলম্বে খুলে দিয়ে পূর্ণ, নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদ সহায়তা প্রবেশ নিশ্চিত করা এবং একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। এর কম কিছু হলে তা কেবল একটি কৌশলগত চাল হিসেবেই বিবেচিত হবে।’
এদিকে, স্কটল্যান্ড সফরে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইসরায়েলকে গাজা পরিস্থিতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তিনি আরও জানান, গত সপ্তাহে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তির আলোচনা থেকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সরে দাঁড়িয়েছে। এরপর কী ঘটবে, তা তিনি জানেন না।