গাজা উপত্যকার পুরো অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থানের নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। এই পরিকল্পনায় ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিয়েছে বলে জানিয়েছেন দুই কর্মকর্তা। নতুন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে আরও ব্যাপক হারে অভিযান প্রসারিত করবে ইসরায়েল। এতে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক বিরোধিতার মুখেও পড়বে দখলদার বাহিনীটি।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর প্রধান হাজার হাজার রিজার্ভ সৈন্য সমাবেশ করার নতুন পরিকল্পনা ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই সোমবার ভোরে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভায় ভোটাভুটির মাধ্যমে পরিকল্পনাটি অনুমোদিত হয়।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইসরায়েলের নতুন পরিকল্পনা হামাসকে ধ্বংস করা ও গাজায় বন্দী থাকা ইসরায়েলিদের মুক্ত করার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে। এর ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণ গাজায় ঠেলে দেওয়া হবে। যেখানে ইতোমধ্যে ভয়াবহ মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন: মার্কিন বিমান হামলায় ইয়েমেনে কারাগারে ৬৮ অভিবাসী নিহত
চলতি বছরের ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় পুনরায় ব্যাপকহারে সামরিক অভিযান শুরু করে। এতে ওই অঞ্চলে বিমান হামলায় শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন, নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আরও লাখো মানুষ। এখন পর্যন্ত গাজার প্রায় ৫০ শতাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)।
বাস্তবতা হলো যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ইসরায়েল গাজায় খাদ্য, জ্বালানি ও পানিসহ সমস্ত মানবিক সহায়তা প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। ফলে প্রায় ১৯ মাসের যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখে পড়েছে অঞ্চলটির বাসিন্দারা।
হামাসের উপর চাপ বাড়ানোর চেষ্টায় ইসরায়েল
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন পরিকল্পনায় অঞ্চলটি দখলের বিষয়টি রয়েছে। একই সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার চেষ্টাও করা হবে। কারণ, তাদের এই কার্যক্রমগুলো গাজায় হামাসের শাসনকে শক্তিশালী করেছে বলে মনে করে ইসরায়েল। এই পরিকল্পনায় হামাসের স্থাপনাগুলোতে শক্তিশালী হামলা চালানোও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা দখল এবং সেখানকার ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র স্থানান্তর করার পরিকল্পনা সম্পর্কে ইসরায়েল বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এটিকে ইসরায়েল ‘স্বেচ্ছায় অভিবাসন’ বলে অভিহিত করেছে। ইসরায়েলের এই পরিকল্পনাটি ইউরোপ এবং আরব বিশ্বে নিজেদের মিত্রদের কাছে ব্যাপক নিন্দিত হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উভয় কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সামরিক পরিকল্পনাটি ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হবে।
হামাসকে যুদ্ধবিরতি চুক্তির আলোচনায় নমনীয় করতে কয়েক সপ্তাহ ধরে চাপ প্রয়োগ করে আসছে ইসরায়েল। কিন্তু আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীরা হামাসকে নমনীয় পর্যায়ে নিতে পারেনি। ইসরায়েলের পদক্ষেপগুলোর কারণে হামাস আলোচনা থেকে সরে যেতেও পারে বলে মনে হচ্ছে।
ইসরায়েলের নতুন পরিকল্পনা হামাসের হাতে জিম্মি থাকা ইসরায়েলিদের পরিবারগুলোতে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। জিম্মি পরিবারগুলোর ফোরাম সোমবার বলেছে, নতুন পরিকল্পনাটি প্রতিটি জিম্মিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। জিম্মিদের মুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে ইসরায়েল সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
সোমবার নেসেট কমিটির বৈঠক থেকে আইনব জাঙ্গাউকার ‘সৈন্যদের আদর্শিক ও নৈতিক কারণে ডিউটিতে না ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন। জাঙ্গাউকার জিম্মি থাকা মাতানের বাবা।
মানবিক সহায়তা বিতরণ থেকে হামাসকে বিরত রাখতে চায় ইসরায়েল
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বিস্তারিত বিবরণ না দিয়ে বলেন, মানবিক সাহায্য বিতরণে হামাসকে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে ইসরায়েল। কর্মকর্তাদের একজন বলেন, ‘মন্ত্রীরা সহায়তা বিতরণের বিকল্প অনুমোদন করেছেন।’
আন্তুর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলোর একটি অভ্যন্তরীণ চিঠিতে এপি দেখতে পেয়েছে, ইসরায়েল জাতিসংঘকে জানিয়েছে যে, তারা গাজায় সাহায্য বিতরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানিগুলোকে কাজে লাগাবে। তবে রবিবার জাতিসংঘ ইসরায়েলের এমন পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে- কারণ এটি তাদের নীতিবিরুদ্ধ।
আরও পড়ুন: গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৬
এদিকে গতরাতে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ১৭ জন নিহত হয়েছেন বলে গাজার হাসপাতাল সূত্র নিশ্চিত করেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাস অভিযান চালানোর পর থেকে যুদ্ধ শুরু হয়। সেই অভিযানে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন ইসরায়েলি নিহত হন। ২৫০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায় হামাস যোদ্ধারা। ইসরায়েল বলছে, জিম্মিদের মধ্যে এখনো ৫৯ জন গাজায় হামাসের হাতে রয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে ৩৫ জন মারা গেছেন।
অন্যদিকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৫২ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। তবে নিহতদের সামরিক ও বেসামরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি।
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় গাজা দখল করে নিয়েছিল আইডিএফ। পরে ২০০৫ সালে বসতিস্থাপনকারী ও সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় ইসরায়েল। দুই বছর পর হামাস অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।