দেশে মানসম্মত কসমেটিকস পণ্য না পাওয়ায় ভোক্তারা বিদেশি পণ্যের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার কারণে বিপুল পরিমাণে অর্থ দেশের বাইরে কোম্পানিগুলোর কাছে চলে গিয়েছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন আনতে দেশেই এখন আন্তর্জাতিক মানের কসমেটিকস পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। দেশে নিজস্ব কারখানায় মানসম্মত পণ্য তৈরির ওপর কসমেটিকস পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানদের নজর দিতে হবে বলে মনে করেন স্কিন কেয়ার বিশেষজ্ঞ ও কসমেটিকস পণ্য সংশ্লিষ্টরা।
বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) রাজধানীর কারওয়ানবাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও এসোসিয়েশন অব স্কিনকেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অব বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ ট্যাগযুক্ত পণ্যের মান’বিষয়ক সেমিনারে এসব কথা বলেন তারা।
বক্তারা বলেন, দেশে দীর্ঘদিন ধরে কসমেটিকস পণ্য উৎপাদিত হলেও মানোন্নয়নে কখনোই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এতে ভোক্তাস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এসব বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও তেমন কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এই সুবাদে বিপুল অংকের টাকা চলে গেছে বিদেশে।
নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে এগুতে হচ্ছে উল্লেখ করে কসমেটিক পণ্য উৎপাদক ব্যবসায়ীরা জানান, দেরিতে হলেও আন্তর্জাতিক পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে দেশীয় কিছু প্রতিষ্ঠান। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মিশেলে এসব প্রতিষ্ঠানের পণ্যগুলো স্থানীয় বাজারে আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। নিজস্ব কারখানায় মানসম্মত পণ্য বাজারজাতকরণে এরই মধ্যে তারা সাড়াও ফেলেছে বেশ। তাদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি রিমার্ক এলএলসি ইউএসএ-এর এফিলিয়েটেড ব্র্যান্ডগুলো সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মিশেলে সর্বোৎকৃষ্ট পণ্য উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।
তারা অভিযোগ করেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করা কোম্পানিগুলো পণ্যের চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন তৈরি, সম্প্রচার এবং মার্কেটিং খাতে বিনিয়োগ করে বাজার সম্প্রসারণে যতটা উদ্যোগী, পণ্যের মান বাড়াতে ঠিক ততটা পিছিয়ে।
কয়েকটি নতুন কোম্পানি দেশে আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিং সম্বলিত পণ্য উৎপাদনে এগিয়ে এসেছে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা।
সেমিনারে বলা হয়, ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস ইন্ট্রাস্ট্রি (এফএমসিজিআই) সেক্টরের আকার উল্লেখযোগ্য হারে বড় হয়েছে, যা একে দ্রুত বর্ধনশীল শিল্পগুলোর মধ্যেও একটি করে তুলেছে। বর্তমানে এ বাজারের আকার প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার হলেও ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজার হয়ে উঠবে। রাজস্ব খাতে এটি প্রত্যাশিত, ২০২৭ সালের মধ্যে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হবে ১৬ শতাংশেরও বেশি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোন কোন কোম্পানি তথাকথিত ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির মতো করে বাংলাদেশের বাজার থেকে শুধু মুনাফাই লুটেছে। কিন্তু ক্রেতাস্বার্থ বিবেচনায় নেয়নি। ফলে দেশের মানুষ বিদেশে থেকে কসমেটিকস ও খাত সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলো নিয়ে আসেন। কারণ তারা মনে করেন, বিদেশি পণ্য এ দেশে উৎপাদিত পণ্যের চাইতে উন্নত।
সেমিনারে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলেন, বাজার নিম্নমানের কসমেটিকস পণ্যে সয়লাব হলে তা মানুষের জীবনে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হবে। ভুয়া পণ্য ব্যবহার করে অনেকে এরই মধ্যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য পরিবারেও দিন দিন আর্থিক সংকট বাড়ছে। এজন্য দেশে বিশ্বমানের কসমেটিকস ও হোমকেয়ার পণ্য উৎপাদনের বিকল্প নেই। এতে দেশের মানুষের কর্মসংস্থানও বাড়বে। রিমার্ক-হারল্যানসহ যে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে গুণগত মান বজায় রেখে অথেনটিক পণ্য দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ভোক্তা অধিদপ্তরও তাদের পাশে থাকবে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, দেশে প্রসাধনী ও ব্যক্তিগত যত্নের সামগ্রীর বার্ষিক বাজার এখন প্রায় ৯০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আশা করা হচ্ছে যে ২০২৭ এ ৮ দশমিক ১ শতাংশ হারে বাড়বে। তবে বাংলাদেশের প্রসাধনী খাত ব্যাপকভাবে আমদানির ওপর নির্ভরশীল। প্রসাধনী রাসায়নিকের ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। বিশেষত, মোট আমদানিকৃত কসমেটিক পণ্যের প্রায় ৪১ শতাংশ ভারত থেকে আসে।
এ অবস্থার পরিবর্তনে মানসম্মত দেশি পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।
স্কিন কেয়ার, কসমেটিকস ও হোম কেয়ার খাতে রিমার্ক-হারল্যানের মতো দেশীয় কোম্পানি এগিয়ে আসায় তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর পরিচালক ইসহাকুল হোসেন সুইট বলেন, এ প্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্মত অথেনটিক পণ্য উৎপাদন করায় ক্রেতাদের মাঝে দেশি পণ্য ব্যবহারে আগ্রহও বাড়ছে।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের (আইবিএফবি) সহসভাপতি এম এস সিদ্দিকী মনে করেন, দেশীয় শিল্পের প্রসারে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। কারণ আমদানি নির্ভরশীলতা কমাতে দেশের কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই। যেসব প্রতিষ্ঠান দেশে আন্তর্জাতিক মানের পণ্য উৎপাদন করছে, তারা যেন বিশেষ নীতিসহায়তা পান, তাও নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে দেশীয় শিল্পের প্রসারে আগ্রহী হয়ে অনেকে এগিয়ে আসবেন।
সেমিনারে বিএসটিআইর উপপরিচালক মোরশেদা বেগম বলেন, পণ্যের মান নিশ্চিত হওয়ার পর যেন বাজারজাত হয় সেজন্য কাজ করছে বিএসটিআই। এছাড়াও নতুন পণ্যের বাজারজাতকরণের আগে পণ্য ও মোড়কসহ সব বিষয়ের মান নিয়ে কাজ করছি। আমরা রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মান নিশ্চিতকরণে জোর দিচ্ছি।
সামগ্রিক উৎপাদনের ৩০ শতাংশ পণ্য বিএসটিআই মান সনদের আওতায় আনতে পেরেছে বলে জানান মোরশেদা বেগম।
চিত্রনায়ক মামনুন হাসান ইমন জানান, দীর্ঘদিন ধরে দেশে মানসম্মত পণ্য উৎপাদিত না হওয়ায় বিদেশি পণ্যের প্রতি মানুষের দুর্বলতা ছিল। এছাড়া বড় কোম্পানিগুলো দক্ষ মার্কেটিং ও সেলস পার্সনদের নিয়োগে বেশি গুরুত্ব দিলেও পণ্যের মানোন্নয়নে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। চটকদার বিজ্ঞাপন তৈরি, প্রচার ও পণ্য বিক্রিতেই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে। গবেষণা ও কারখানা ব্যবস্থাপনাসহ মৌলিক জায়গাগুলোয় তেমন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। এটি প্রকারান্তরে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।
তিনি আরও বলেন, দেশে এখন মানসম্মত পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, তার প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহও বাড়ছে। সুতরাং দেশে উৎপাদিত গুণগত মানের পণ্যের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস যেন বাড়ে সে উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। দেশে উৎপাদিত মানসম্মত ও অথেনটিক পণ্য ব্যবহারে মানুষের মাঝে আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। মানুষ এখন দেশি পণ্য ব্যবহার করতে চায়।
এক্ষেত্রে রিমার্ক-হারল্যানসহ দেশীয় কিছু কোম্পানি এগিয়ে আসায় তাদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান ইমন।
প্রসাধনী খাতের বাণিজ্য সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দীন বলেন, বাংলাদেশ কনজিউমার গুডস খাতে বড় বাজার হলেও পণ্য বিক্রেতাদের আন্তর্জাতিক মানের বিষয়টি আমলে নিতে দেখা যায়নি। মানহীন ও ভেজাল পণ্য কিনে ক্রেতারা প্রতারিত হতেন। দীর্ঘদিন পর হলেও ভোক্তা অধিকার ভেজাল রোধে কাজ করছে। ফলে মানুষের মাঝে সচেতনতা বেড়েছে। চাহিদা তৈরি হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির পণ্যের।
বেশ কিছু কোম্পানি এখন উন্নত ফর্মুলেশন-গবেষণা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে বলে জানান তিনি।
স্কিন কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডা. শারমিনা হক মনে করেন, নকল ও ভেজাল পণ্য ব্যবহার করে মানুষ স্কিন ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় মানসম্পন্ন পণ্য ব্যবহার করা। রিমার্ক ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে, মানুষের জীবনমান উন্নয়নে যেসব পণ্য বাজারে আনছে, আশা করি দেশের মানুষ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এসব পণ্য ব্যবহার করে উপকৃত হবেন।
সেমিনারে ড. সাকুন মাংগুত বলেন, বাংলাদেশে পণ্য নয় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে বেশি নজর দেওয়া উচিত। বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের আস্থা অর্জনে গবেষণায় জোর দিতে হবে।
দেশি ব্র্যান্ডগুলোকে উন্নত করে ভোক্তার আস্থা অর্জনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে পরামর্শ দেন তিনি।