স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা জানান, শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সুমনের উত্থান ২০০০ সালের দিকে। তিনি অনেক আগে থেকেই চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত ছিলেন। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও তার সখ্যতা গড়ে উঠে। এলাকায় পাপিয়া ও সুমন সদর আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম হিরুর বলয়ের লোক হিসেবে পরিচিত। ২০১৪ সালে জেলা যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে পাপিয়া সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার হঠাৎ এত বড় পদ পাওয়ায় তখন অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন।
নরসিংদী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন ভূঁইয়া বলেন, ‘পাপিয়াকে রাজনীতির মাঠে আমদানি করেছেন এমপি নজরুল ইসলাম হিরু। এর দায় দলের অন্য কেউ নেবে না।’
সুমন ও পাপিয়ার বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তারা রাজনৈতিক পরিচয় ভাঙিয়ে ঢাকায় কী করছে সেটা দেখার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করেছে, তারাই সব বের করবে। আর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন কেন্দ্রীয় নেতারা।’
নরসিংদীর পৌর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল জানান, পাপিয়াকে যুব মহিলা লীগ নেত্রী বানানোর সময় স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বিরোধিতা করেছিলেন। তবে কেন্দ্রীয় নেতারা তা আমলে নেননি। কাউন্সিল শেষে ঢাকা থেকে পাপিয়ার নাম ঘোষণা করা হয়।
‘অনেক বছর পাপিয়া ও তার স্বামীর নরসিংদীতে তেমন যাতায়াত ছিল না। বছর খানেক ধরে তারা এলাকায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করছেন। কে বা কারা তাদের প্রশ্রয় দিতেন তা এলাকায় ওপেন সিক্রেট। তবে চলাফেরা অস্বাভাবিকতা থাকায় সাধারণ নেতা-কর্মীরা পাপিয়াকে পছন্দ করতেন না,’ বলেন তিনি।
জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি তৌহিদা সরকার রুনা বলেন, ‘পাপিয়া যদিও কমিটির সাধারণ সম্পাদক কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। তাছাড়া পাপিয়া সাধারণ সম্পাদক হলেও দলীয় কর্মকাণ্ডে দুই-একটা সভা ছাড়া তেমন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেননি।’
নরসিংদীর একাধিক রাজনৈতিক নেতা জানান, পাপিয়া যে ঢাকায় অভিজাত হোটেল ভাড়া নিয়ে অসামাজিক ব্যবসা চালাতেন এটা অনেকেরই জানা ছিল। তবে প্রভাবশালীদের সাথে তার ওঠবস থাকায় এ নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে কিছুই বলতেন না।
এসব বিষয়ে নজরুল ইসলাম হিরু দাবি করেন, পাপিয়া লবিং করে ঢাকা থেকে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান। ২০১৪ সালে কাউন্সিল মঞ্চে স্থানীয় নেতাদের তোপের মুখে পাপিয়াকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করতে পারেনি কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগ। পরে ঢাকায় পাপিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা কমিটি ঘোষণা করা হয়।
‘যুব মহিলা লীগের কাউন্সিলের সময় আমি মঞ্চে বসে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আক্তারকে অনুরোধ করেছিলাম পাপিয়াকে কোনোভাবেই দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে না আনতে। তখন নাজমা আক্তার, বর্তমান শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন ভূঁইয়া আমার সাথে একমত হয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল একমত না হওয়াতে আমার সাথে কথা কাটাকাটি হয়। পরে আমি নরসিংদীর কাউন্সিলে কমিটি ঘোষণা করতে দেইনি। পরে ঢাকায় কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরে পাপিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা কমিটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সেটা কী কারণে করা হয় তা আজও আমার অজানা রয়ে গেছে,’ যোগ করেন তিনি।
পাপিয়া ও তার স্বামী সুমনের অপকর্মের দায় সম্পর্কে নজরুল ইসলাম হিরু বলেন, ‘যেখানে পাপিয়ার অপকর্মের দায় যুব মহিলা লীগ নিচ্ছে না সেখানে আওয়ামী লীগের দায় নেয়ার প্রশ্নই আসে না। আর পাপিয়ার স্বামী সুমন কার লোক, তাদের জন্ম কোথায় তা নরসিংদীবাসী জানে। আমি রাজনীতিতে আসার আগেই সুমন ছিল প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের দেহরক্ষী। সুমনকে যারা তৈরি করেছেন এ দায় তাদের, আওয়ামী লীগের নয়। আর নরসিংদীর রাজনীতিতে সুমন ও পাপিয়া আমার অনুসারী না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমার নির্বাচনী প্রচার করতে চেয়েছিল পাপিয়া ও সুমন। আমি বলেছি আমার নির্বাচনী প্রচারণা তোমাদের করতে হবে না। কারণ তারা ভোট চাইলে আমার ভোট আরও কমবে।’
উল্লেখ, পাপিয়া ও সুমনসহ চারজনকে শনিবার বেলা ১১টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তারা দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। এ সময় তাদের কাছ থেকে সাতটি পাসপোর্ট, ২ লাখ ১২ হাজার নগদ টাকা এবং বিভিন্ন দেশের বিপুল পরিমাণ জাল মুদ্রা জব্দ করা হয়।
পরে র্যাব রবিবার রাজধানীতে পাপিয়ার দুটি বাড়ি ও তার ভাড়া করা পাঁচতারকা হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে তল্লাশি চালিয়ে ৫৮ লাখ ৪১ হাজার নগদ টাকাসহ অন্যান্য সামগ্রী জব্দ করে। এ ঘটনায় সোমবার পাপিয়া ও সুমনকে বিমানবন্দর ও শের-ই-বাংলানগর থানার তিন মামলায় ১৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে ঢাকার দুই আদালত। সেই সাথে তাদের ব্যক্তিগত সহকারী সাব্বির খন্দকার ও শেখ তায়্যিবাকে এক মামলায় পাঁচ দিন করে রিমান্ড দেয়া হয়।